প্রচারের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী সাঁওতালি পুতুল শিল্প

Advertisement
প্রচারের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী সাঁওতালি পুতুল শিল্প
বিজয় ঘোষাল :নাচায় পুতুল দক্ষ কারিগরে”, পুতুল নাচ সম্পর্কিত এই উক্তি কমবেশি প্রায় সবারই জানা। এককালে লৌকিক সংষ্কৃতির অঙ্গনে পুতুল নাচ এক অনবদ্য স্থান অধিকার করেছিল। অচেতন পুতুলগুলিকে জীবন্ত করে তুলতে নাচানো হত হাতের ইশারায়। সেকালে গ্রাম-গঞ্জের বাড়িতে টিভি (টেলিভিশন) নামে ‘বোকা বাক্স’-টি আসার পূর্বে মেলার মাঠে দর্শকদের মনোরঞ্জনের অন্যতম মাধ্যম ছিল এই পুতুল নাচ।
     কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের রুচিরপরিবর্তন ঘটেছে অনেক। এখন মোবাইল-কম্পিউটারের যুগে জীবন্ত পুতুলগুলি নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে আবার। গ্রাম-গঞ্জের কাঠের পুতুলগুলিকেও বাক্স বন্দী করে রেখেছে একালের ছেলে-মেয়েরা। কারণ ভিডিও গেমের যুগে সেগুলিরও আকর্ষণ কমে গিয়েছে তাদের কাছে। পুতুল কেনার বায়নাও হারিয়ে গিয়েছে ধীরে ধীরে।
     যাইহোক, সেসময়ে বেশ জনপ্রিয় ছিল সাঁওতালি পুতুল নাচ। যে কোনও অনুষ্ঠানে শিল্পীদের হাতের ইশারায় নেচে উঠত অচেতন পুতুলগুলি। এখন অবশ্য হারিয়ে যেতে বসেছে সেই লোকশিল্পটি এবং সেই সঙ্গে পুতুল নাচের সঙ্গে জড়িত শিল্পী ও পুতুল তৈরির কারিগরেরাও।
     এই রকমই একটি চিত্র ধরা পড়ল বীরভূম জেলা বোলপুর সংলগ্ন কংকালীতলা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ব্যাঁকাজল নামেরসাঁওতাল আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামে। এই গ্রামের ৭০ উর্দ্ধ সোম মু্র্মু একজন সাঁওতালি পুতুল শিল্পী। আজও অর্ডার পেলে পুতুল নির্মান করেন। কিন্তু প্রচারের অভাবে তাঁর শিল্পকর্ম লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে গিয়েছে।
     অন্যদিকে আর একটি চিত্র ধরা পড়ল, ওই একই জেলার সাঁইথিয়া ব্লকের অমরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত নিমডাঙা গ্রামেও। এই গ্রামের আদিবাসী পুতুল নির্মাণ করেন সুকুল মার্ডি। তিনিও বেশ প্রবীণ শিল্পী। তাঁর অবস্থাও ওই একই রকম।
প্রচারের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী সাঁওতালি পুতুল শিল্প
     সাঁওতালি সংস্কৃতির অঙ্গনে এই পুতুলগুলি চদর-বদর পুতুল নামে দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত। এগুলি মাধ্যমে যে নাচ দেখানো হয়, তা সাঁওতালি কথ্য ভাষায় চাদর বাঁধনী বা চাদর বাদর এনেচ নাম দেওয়া হয়েছে। সাঁওতালী সংস্কৃতির এই লুপ্তপ্রায় পুতুল শিল্পকর্ম ও একে ঘিরে থাকা এই লোকয়ত পেশা ও শিল্পকর্ম খুবই কমই আলোচনায় এসেছে।
     শিল্পীদের কথায়, পূর্বে পুজোর সময় দশমীর দিনে সিঁধে নেওয়ার সময় সাঁওতাল শিল্পীদের চাদর বাঁধনী পুতুল নাচ দেখানোর রেওয়াজ ছিল। সাঁওতালি জনজীবনে থাকা বিভিন্ন জনশ্রুতির পরিচয় পাওয়া যেত এই পুতুল নাচের মধ্যে। কিন্তু লোকসঙ্গমে জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমে আসায়, বর্তমানে খুব কমই চোখে পড়ে এই সাঁওতাল লোকসংস্কৃতিটিকে
     সোম মু্র্মু শৈশব থেকে যুক্ত আছেন পুতুল তৈরির সাথে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বিহার,ঝাড়খন্ড প্রভৃতি রাজ্য থেকে আসা সংস্কৃতি মনষ্ক মানুসেরা তাঁর তৈরি পুতুল কিনে নিয়ে গিয়েছেন এক সময়ে। তাঁর হাতের তৈরির পুতুল নেচেছে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের বিভিন্ন অংশে। তবে তিনি নিজে কোনদিন পুতুল নাচাননি। কিন্তু ইলামবাজার ব্লকের কামারপাড়া গ্রামে চাদর বাঁধনী পুতুল দলের সঙ্গে কাজ করেছেন বহুদিন
     সোম মু্র্মু জানালেন, এককালে কামারপাড়ার চাদর বাঁধনী পুতুল নাচের নাম লোকের মুখে মুখে ঘুরত। ওই গ্রামের মাতাল মু্র্মু এক সময়ে ছিল এই পুতুল নাচের দক্ষ শিল্পী। তাঁর মৃত্যুর পর হারিয়ে যেতে বসেছে পুতুল নাচের এই আঙ্গিকটি। সেই সঙ্গে তাঁর কাছেও পুতুল তৈরির অর্ডার কমে গিয়েছে। তিনি আরও জানালেন, শুধু পুতুল নয়, তিনি নিজের হাতে বানাম সহ অন্যান্য চিরাচরিত আদিবাসী বাদ্যযন্ত্রও তৈরি করে থাকেন
     কিন্তু অবাক হতে হয়, শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের মতো নামী শিল্পকর্ম-স্থানের এত কাছে থাকা সত্ত্বেও আজও প্রচারের আলোয় আসেনি সোম মু্র্মুর নিজের শিল্পকর্ম। এখন একপ্রকার পুতুল তৈরির কাজ প্রায় ছেড়েদিয়েছেন তিনিবহু অসমাপ্ত পুতুল এখনও ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর বাড়ির আঙিনা জুড়ে। হয়তো সমাপ্ত করার কথাও ভুলে গিয়েছেন তিনি। অনাদরে এখানে-সেখানে পড়ে রয়েছে হাতুড়ি, বাটালী, রং ও তুলি সহ পুতুল তৈরির বিভিন্ন উপাদান।
     ওই একই অবস্থা নিমডাঙার সুকুল মার্ডিরও। পাশ্ববর্তী বিহার ও ঝাড়খন্ড রাজ্যে সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আজও সমান জনপ্রিয়তা রয়েছে এই চাদর বাঁধনী পুতুল নাচের। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই সাঁওতালি লোকশিল্পের প্রচারের জন্য এগিয়ে আসেনি কেউই। এগিয়ে আসেনি প্রশাসন অথবা কোনও বেসরকারী সংস্থা। এই লৌকিক শিল্পকর্ম বাঁচাতে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নিবর্তমান শিক্ষিত সাঁওতাল যুব সম্প্রদায়কেও। ফলে সোম মু্র্মু ও সুকুল মার্ডি অবর্তমানে হয়তো কোনও একদিন চদর বদর পুতুল শিল্প হারিয়ে যাবে চিরদিনের জন্য।
  • All Rights Reserved
Advertisement
Previous articleএবার ম্যালেরিয়া নাশ করতে আবিষ্কার হল জীবাণু
Next articleবীরভূম জেলা জুড়ে ত্রাণ বিতরণ করল ডিস্ট্রিক লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটি

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here