Advertisement
ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মে মাস মানেই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের জন্ম মাস। দুই বাংলার এই দুই শ্রেষ্ঠ কবির মতাদর্শ ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কত আলোচনায় না হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। কিন্তু তাঁদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সুসম্পর্কের কথা ক’জন জানে। (ছবি : সংগৃহীত)
|
অতনু কুমার সিংহ : মে মাস। ইংরেজি ক্যালেণ্ডারের পঞ্চম মাস। বাঙালির গর্বের ধন দুই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (০৭/০৫/১৮৬১ – ০৭/০৮/১৯৪১) ও কাজী নজরুল ইসলাম (২৫/০৫/১৮৯৯ – ২৯/০৮/১৯৭৬)-এর জন্মমাস। ২০১১-তে রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী ও ১৯৯৯-এ নজরুলের ১০০তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘বিশ্বকবি, নজরুলের জন্মস্থান ভারতে হলেও তাঁকে ঢাকায় এনে নাগরিকত্ব প্রদান করে ‘জাতীয় কবি’-র স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দু’জনেই ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁদের সাহিত্য ও গান বাংলা ও বাঙালির সম্পদ। অথচ, তাঁদের জীবদ্দশাতেই জাতিগত ধর্মান্ধ সমালোচকেরা এই দুই মহান কবির মতাদর্শ ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে বেশকিছু বিভ্রান্তিকর মতামত ব্যক্ত করে তাঁদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরেও সেই প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন অব্যাহত ছিল। অথচ, বাংলা সাহিত্যের দুই মহান কবির মধ্যে ছিল এক গভীর সৌহার্দ্যপূর্ণ সুসম্পর্ক। তাঁদের মধ্যে তুলনামূলক শ্রেষ্ঠত্বের বিচার যেমনি অবান্তর, তেমনই অমূলক ও অপ্রাসঙ্গিক।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বয়সের ব্যবধান ছিল ৩৮ বছর। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩-তে যখন নোবেল পুরস্কার পান (বয়স ৫২ বছর) তখন দুখু মিঞা (নজরুলের ডাকনাম) ছিলেন নাবালক, বয়স মাত্র ১৪ বছর। গ্রামগঞ্জে লেটো দলে গান গেয়ে, মসজিদে বালক ইমামের কাজ করে অর্থ উপার্জন করছেন। নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবন খুবই সংকীর্ণ, মাত্র ২২ বছর। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীল জীবনের এক তৃতীয়াংশ। অবশ্য চিত্রাঙ্কন, বিদেশ ভ্রমণ ছাড়া প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নজরুল তাঁর প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। গানের সংখ্যায় নজরুল রবীন্দ্রনাথকেও ছাপিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রসংগীতের সংখ্যা নির্দিষ্ট, ২২৩২টি, কিন্তু অদ্যাবধি ৩০৯৪টি নজরুলগীতির সন্ধান পাওয়া গেছে।
দুই কবির বংশমর্যাদা ছিল ভিন্ন। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ঐশ্বর্যশালী ও ইংরেজ-আশীর্বাদপুষ্ট অভিজাত পরিবারে। জমিদারীও তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। অল্প বয়সেই বিলেতে গেছেন দু’বার, উচ্চশিক্ষার জন্য। জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও বঙ্গভঙ্গ ছাড়া অন্য কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনে সরাসরি লিপ্ত হননি। ইংরেজ শাসনকে সমর্থন জানিয়ে লিখেছিলেন, “পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার, / দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, / যাবে না ফিরে”। তাঁর রচিত “জনগণমন অধিনায়ক” ভারতের ও “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।
অন্যদিকে নজরুলের জন্ম ব্রিটিশ-শাসিত ভারতবর্ষে বর্ধমানের চুরুলিয়ায়, এক দীনহীন পরিবারে। স্কুলের বাধাধরা পড়াশোনা রবীন্দ্রনাথের পছন্দ ছিল না। নজরুলেরও স্কুলের পড়া শেষ করা সম্ভব হয়নি, ভিন্ন কারণে— পিতার মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ। ১৭ বছর বয়সে করাচির ৮৯নং বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন। দেশের স্বার্থে যাঁর অসীম সাহস দেশদ্রোহী করে তুলেছিল। তিনি লিখেছিলেন, “মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত, / আমি সেই দিন হব শান্ত, / যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, / অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না…”। তাঁর লেখা বই ইংরেজরা শুধু বাজেয়াপ্ত করেনি, কারারুদ্ধও করেছিল। “রাজবন্দীর জবানবন্দি”-তে তিনি লিখেছিলেন, “আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজদ্রোহী। তাই আমি আজ কারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত…”।
অনুজ নজরুলের প্রতি ছিল অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ এবং অগ্রজের প্রতি ছিল অনুজের শ্রদ্ধা ও ভক্তি। রবীন্দ্রনাথ যখন লিখছেন (ফাল্গুন ১৩০২), “আজি হতে শতবর্ষ পরে / কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতুহলভরে, …”, উত্তরে নজরুল লিখেছেন (আষাঢ় ১৩৩৪), “আজি হ’তে শতবর্ষ আগে / কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে / শত অনুরাগে…”।
যুদ্ধের সময় মনোবল বাড়াতে নজরুলের ট্রাঙ্কে থাকত রবীন্দ্রনাথের গানের বই। রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নজরুল লিখেছিলেন, “তুমি স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, বিস্ময়ের বিস্ময় / তব গুন গানে ভাষা সুর যেন যব হয়ে যায় লয়…”, (তীর্থ পথিক)। ১১ আগস্ট ১৯২২-এ নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা “ধুমকেতু”-র সম্পাদকীয়তে রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে লিখিত আট লাইনের আশীর্বাণী ছাপা হয়, “আয় চলে আয়, রে, ধুমকেতু, / আধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,…”।
পত্রিকার ১২শ সংখ্যায় (২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২) নজরুলের “আনন্দময়ীর আগমনে” কবিতা প্রকাশের পর তাঁকে গ্রেফতার করা হয় ও রাজদ্রোহের মামলায় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। নজরুল আলিপুর জেলে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ “বসন্ত” গীতিনাট্যটি তাঁকে উৎসর্গ করেন। অগ্রজ কবির আশীর্বাদের প্রত্যুত্তরে ১৯২৮-এ অনশন-ক্লিষ্ট নজরুল জেলে থাকার যন্ত্রণা, ক্লেশ ভুলে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন “সঞ্চিতা” কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন। অনেকগুলি জেল বদলের পর ১৪ এপ্রিল ১৯২৩, নজরুল হুগলি জেলে থাকাকালীন ৩৯ দিনব্যাপী অনশন করেন। রবীন্দ্রনাথ সে খবর পেয়ে প্রসিডেন্সি জেলের ঠিকানায় অনশন ভাঙার প্রস্তাব জানিয়ে টেলিগ্রামে লেখেন, “Give up hunger strike, our literature claims you.” যদিও জেল পরিবর্তনের জন্য এই চিঠি নজরুল হাতে পাননি, তবে এই চিঠির প্রসঙ্গ জেল থেকে বেরিয়ে এসে পেয়েছিলেন।
অক্টোবর ১৯২১, নজরুলের বয়স যখন ২২ বছর, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের প্রথম দেখা হয়। রবীন্দ্রনাথের একান্ত সচিব সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর দেওয়া বর্ণনা থেকে (মোসলেম ভারত, কার্তিক ১৩২৭) জানা যায়, নজরুল রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি কবিতা শুনতে চাইলে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “সে কি? আমি যে তোমার গান ও আবৃত্তি শোনবার অপেক্ষায় আছি…।” এইদিন নজরুল তাঁর “অগ্নিবীণা” কাব্যের “আগমণী” কবিতা পাঠ করা ছাড়াও বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেছিলেন, “মাধবী হঠাৎ কোথা হতে, এল ফাগুন দিনের স্রোতে…”। এর প্রায় দুই মাস পরে তাঁদের পুনরায় সাক্ষাৎ হয় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। ২৫ জুন ১৯২২, কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরিতে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক শোকসভায় দেখা হলে রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে ডেকে পাশে বসান, নজরুল ‘সত্যকবি’ কবিতাটি পাঠ করেন।
“ধুমকেতু” বন্ধ হয়ে গেলে নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশিত “লাঙল” পত্রিকার (ডিসেম্বর ২৫, ১৯২৫) প্রচ্ছদ ছিল রবীন্দ্রনাথের শুভেচ্ছাসিক্ত। রবীন্দ্রনাথের “গোরা” উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছায়াছবিতে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের শত বাধা সত্বেও রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত পরিচালক নজরুলকে স্বীকৃতি প্রদান করেছিলেন। জুন, ১৯৩৫-এ “নাগরিক” পত্রিকার জন্য নজরুল রবীন্দ্রনাথকে লেখা দেওয়ার অনুরোধ জানান। অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ নজরুলের আবেদনে সাড়া দিয়ে লিখেছিলেন, “…তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছে আর কিছু না হোক করুণা দাবি করতে পারে। শুনেছি বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি পাশের জিলায় (বীরভূমের বোলপুরে)। কখনো যদি ঐ সীমানা পেরিয়ে আমাদের দিকে আসতে পারো খুশি হব”। নজরুল পত্রিকাটিতে প্রত্যুত্তরে লিখেছিলেন, “হে কবি, হে ঋষি অন্তর্যামী আমারে করিও ক্ষমা। / পর্বত-সম শত দোষত্রুটিও চরণে হল জমা।…”
রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে গভীরভাবে শোকবিহ্বল নজরুল লেখেন, “দুপুরের রবি ঢলে পড়েছে অন্তপারের কোলে” ও “ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত কবিরে, জাগায়ো না জাগায়ো না”। প্রথম কবিতাটি “রবিহারা” আকাশবাণী বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত ধারাবর্ণনায় কবিতাটি পাঠ করার সময় নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন, তার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে যায়, তাঁর আবৃত্তি সম্পূর্ণ করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর প্রায় মাত্র ২২ মাসের মধ্যে নজরুল সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁর কণ্ঠ ও কলম স্তব্ধ হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, আরও হবে, এবং আগের তুলনায় নজরুলচর্চা, গবেষণাও অনেকটা বেড়েছে। নজরুলের জন্মদিনে এখনও তাঁর গান বাজতে শোনা যায়। রবীন্দ্রনাথের “এসো হে বৈশাখ” গান ছাড়া বাঙালির নববর্ষ যেমন অপূর্ণ থেকে যায় “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” কালজয়ী গান ছাড়া বাঙালির ঈদও পূর্ণ হয় না। শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় এবং প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠ ও সুরে গাওয়া গানটিই হোক বিপদে-আপদে, সুখে-দুঃখে আমাদের পথ চলার পাথেয়- “সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ / চেতনাতে নজরুল…”।
তথ্যঋণ : রবীন্দ্র-রচনাবলী (বিশ্বভারতী); কাজী নজরুল ইসলাম রচনাসমগ্র (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমি) ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা।
(লেখক বিশ্বভারতী পল্লী শিক্ষা ভবন গ্রন্থাগারের কর্মি ও পল্লী সম্প্রসারণ কেন্দ্রের গবেষক)
Advertisement
দুই বাংলার দুই কবি বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন বুঝলাম না!
দুই বাংলার কথাটা এলো কোত্থেকে? সেদিক থেকে দেখলে দুজনেই পশ্চিম বাংলার কবি, তবে বৈষম্য না টেনে দুজনেই বাংলার কবি বলাই উচিত বলে মনে হয়।