ঐতিহাসিক ঈদ উৎসবের প্রারম্ভ ও ব্যঞ্জনা

Advertisement
n
অসিকার রহমান : ইসলামী যুগের শুরুতে আরব দেশে বেশ কয়েকটি উৎসবের প্রচলন ছিল এগুলোর মধ্যে নৌরজ, মেহেরজান, আনুরা উৎসব উল্লেখযোগ্য মহা ধুমধামের সঙ্গে উদযাপিত হত আলহাদীসের আলোচকগণ প্রধান উৎসব দুটির নাম বলেছেনইয়াত্তমুন্নিরূয’ এবংইয়াত্তমুল মেহেরজান সংক্ষেপে নিরূও মেহেরজান দিবস উৎসব দুটির উৎসে কিছু ইতিহাস আছে সে যাইহোক, নিরূও মেহেরজান শব্দ দুটি কিন্তু আরবী শব্দ নয় ফারসিনওরোজমেহেরজানশব্দের আরবী অপভ্রংশ মাত্র এ দুটি পারসিক সংস্কৃতির নিদর্শনসরূপ
     উৎসব দুটির বিবরণে জানা যায়, মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ অনুযায়ী পারস্য দেশে নওরোজ উৎসব পালিত হত ফারসি সৌর মাসের নামমেহের সাধারণত বাংলা কার্তিক মাসের মাঝামাঝি সময়ে মেহেরজান উৎসবটি অনুষ্ঠিত হত এ উৎসবটিও প্রথমে পারস্য দেশে চালু হয় পরবর্তী কোনও এক সময় এই উৎসব দুটি সমগ্র আরবে ঢুকে পড়ে এবং প্রভূত সমাদর লাভ করে এ ছাড়া আরবের আদি উৎসবউকাযমেলা তো ছিলই
     এই মেলাগুলোতে বিভিন্ন প্রকার বিনোদনের ব্যবস্থা থাকত বিনোদনের নামে এগুলোতে জুয়োখেলা, মদ্যপান, ঘোড়দৌড়, ব্যভিচার ইত্যাদি অপকর্ম সংঘটিত হত কখনওবা দাঙ্গাহাঙ্গামা এমনকি যুদ্ধবিগ্রহ বেধে যেত এই সব নিয়ে তখন সমগ্র আরব দুর্নীতিগ্রস্থতা থেকে মানুষকে নিষ্কণ্টক করতে বিশ্বনবী রসুলুল্লাহ (সাঃ) গভীরভাবে ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি পরিশুদ্ধ জাতীয় উৎসবের কথা মাথায় রেখে দুটি উৎসব উদযাপনের সূচনা করলেন পুরনো উৎসবের আঙ্গিকে আমুল পরিবর্তন ঘটিয়ে উৎসব দুটির নাম দিলেনঈদউলফেৎরএবংঈদউলআজহা এই উৎসবের জন্মলগ্ন কাল ইতিহাসের পাতায় উৎকলিত আছে
     উৎসব দুটির সূচনার অনতিপূর্বে মহানবী (সঃ) প্রতিকূল অবস্থার চাপে পড়ে মক্কা ছেড়ে মদিনা গমন করতে বাধ্য হন এই দিন থেকে হিজরী সনের সৃষ্টি হিজরী দ্বিতীয় অব্দের মধ্যভাগে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ৬২৩ অব্দে ঈদউলফেৎর উৎসবটির প্রচলন হল হিজরী বর্ষের নবম মাস রমজান এই মাস জুড়ে উপবাসব্রত বাধ্যতামূলক বিধানে পরিণত হল ঠিক একমাস পর রোজা শেষে পরবর্তী হিজরী মাস সাওয়াল এর প্রথম দিবসটি ঈদউলফেৎর উৎসবের জন্য নির্ধারিত হয় উৎসবটির নামের বাংলা অর্থ দাঁড়ায়রোজা ভঙ্গ করার উৎসব ইসলামী বিধানে রমজান বা রোজাস্ফটিকস্বচ্ছসাধনা’-র একটি প্রতীকী মাস রোজা বলতে বোঝায় রাত্রির শেষ লগ্ন থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাসের নিয়ত করে খাদ্য, পানীয় ও যাবতীয় ইন্দ্রিয় তৃপ্তিকর কাজ থেকে বিরত থাকা আসলে রোজা পালন যাবজ্জীবন সংযম রক্ষার বাৎসরিক অনুশীলন এক কথায় রোজা অখণ্ড সংযমের প্রতীক
     এই উৎসবে একটি বাধ্যতামূলক দানের কথা বলা হয়েছে সাধারণত দানের কোনও নির্দিষ্টতা থাকে না কিন্তু এক্ষেত্রে ন্যুনতম দানের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে এর পরিমাণ প্রত্যেকের জন্য আরবী ওজনে ১/সাঅর্থাৎ ভারতীয় ওজনে দুকিলোর কাছাকাছি প্রধান খাদ্যশস্যের এই পরিমাণের সমতুল্য অর্থও দান করা যেতে পারে এই দানের নামফিতরা প্রতিটি সক্ষম পরিবারকে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য এমনকি ঝিচাকর ও আশ্রিতদের পর্যন্ত ফিতরা দেওয়া বাধ্যতামূলক ওই দিনের নবজাতক শিশুর জন্য এই দান আবশ্যিক করা হয়েছে এটাকে বলা যেতে পারে এক ধরণের মাথাপিছু কর এই দানের সমগ্রটা গরীব, দুঃখী ও নিঃস্বদের প্রাপ্য ইদের নামাজের পূর্বেই এই দান দেওয়া ফরজ যাতে সকলেই ঈদ উৎসবের আনন্দে অংশগ্রহণ করতে পারে একে দানের উৎসবও বলা হয়
     একমাস ধরে উপবাসব্রতের সমাপ্তি বার্তা ঘোষণা করে ঈদের আগমন যে ব্যক্তি ধারাবাহিকভাবে নিষ্ঠার সাথে সারা মাস রোজা রাখে সে আল্লার প্রকৃত ইবাদতকারী, প্রকৃত আরাধক, মুফতি, মোমিন রোজা শেষে তার সমস্ত পাপ খণ্ডন হয় এবং সে শিশুর মত, ফুলের মত পবিত্র হয়ে ওঠে সর্ববিধ সংযম মানুষকে পবিত্রতার শীর্ষশিখরে পৌঁছে দেয় এই শিক্ষা যাঁরা রমজান থেকে গ্রহণ করতে পারেন, সত্যিই তাঁরা ধন্য তাঁরা মহীয়ান, কেন না সাধনার নিরিখে, আঙ্গিকে এই পর্বটি উত্তীর্ণ হওয়া যে কতখানি আয়াসসাধ্য তার বর্ণনা বাক্যসসীমতার উর্দ্ধে তাই এই কঠিন কাজটি সমাপ্তি লগ্নে রোজা পালনকারী ব্যক্তিটি যখন সন্ধ্যার আকাশে ক্ষয়ে যাওয়া কাস্তের মতো একফালি বাঁকা চাঁদের অতিক্ষীণ ঝলক দেখেন, সেই মাত্র তাঁর বুক জুড়ে পুলকানুভূতির কাঁপন শুরু হয়ে যায় এই সুখানুভূতি অতুলনীয়, সাধনায় সুসিদ্ধ উত্তীর্ণতার আনন্দে কারও বা চোখে অশ্রুর রেখা বয়ে যায়, ক্ষণিকের জন্য
     ঈদউলফিৎর পরবটি আনুষ্ঠানিক হলেও সম্পূর্ণভাবে অনুভূতিক রমজান অন্তে পরদিন সকাল সকাল উঠে আবালবৃদ্ধবনিতা সাধ্যমতো ভালো পোশাক পরে ঈদের আনন্দে অংশীদার হতে লোকালয়ের বাইরে অনতিদূরে ঈদগাহের দিকে যাত্রা করে ফুরফুরে মেজাজে কারও মনে হতে পারে রবীন্দ্রনাথের গানের কথা, “এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার / আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার…”
     নামাজের উদ্দেশ্যে এই যাত্রা আসলে আত্মিক অভিসার নামাজ শুরু হয় সম্মিলিতভাবে অর্থাৎ জামাতের মাধ্যমে নামাজের বাড়তি আনন্দলাভের উদ্দেশ্যেই উন্মুক্ত আকাশের নিচে এই নামাজ অনুষ্ঠিত হয়, অবশ্য প্রাকৃতিক প্রতিকূলতায় মসজিদেও পড়া যায় ঈদ নিয়ে নজরুলের সেই বিখ্যাত গানটির কথা মনে পড়ে, “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ / তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ…”
     সত্যিই তো নিজের হৃদয়কে অন্যের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার আসমানী তাগিদ অনুভব করাই তো ঈদউৎসবের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য পার্থিব বস্তু ইচ্ছা থাকলেই দান খয়রাত করা যায় কিন্তু ঈদ তারও অধিক কিছু দাবি করে নিজের ভিতর যে অহংকার তা মানুষকে সহজ ও সুন্দর হতে বাধা দেয় মানুষকে মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে এই উৎসবের আহ্বানে মানুষকে বেরিয়ে আসতে হবে তার ভিতর থেকে সমস্ত মায়াজাল ছিঁড়ে মানুষ আত্মমুখীনতা ও অহংবোধ ত্যাগ করে বেরিয়েও আসে পবিত্র ঈদের দাবি মতো সে নির্দ্বিধায় শত্রুর বুকে, ভিখারির বুকে বুক মেলায় মানুষ খুঁজে পায় মানসিক প্রশান্তির ঠিকানা ঈদ তাই পবিত্র মার্জিত শুচিশুদ্ধ জীবনসংস্কৃতির ব্যঞ্জনাময় প্রতীক
(লেখক বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধনিক, খুজুটিপাড়া, বীরভূম)
  • All Rights Reserved
Advertisement
Previous articleলকডাউনে অসহায় শিল্পীদের পাশে দাঁড়াল অপর শিল্পী সংগঠন
Next articleলকডাউনে প্রথমবারের জন্য স্থগিত রাখা হল ‘মা ওলাইচণ্ডী’র মেলা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here