আধুনিক খেলনার ভিড়ে এখন অনেকটাই কোণঠাসা “তালপাতার সেপাই”

Advertisement
“তালপাতার সেপাই” আর ঘোরে না কচিকাঁচাদের হাতে হাতে। এক সময়ের জনপ্রিয় এই খেলনার প্রায় প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আধুনিককালের প্ল্যাস্টিকজাত ও ইলেক্ট্রনিকের খেলনা সামগ্রী। তবু কোনও রকমে বাংলার এই লোকশিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন বীরভূমের কয়েকটি শিল্পী পরিবার।

আধুনিক খেলনার ভিড়ে এখন অনেকটাই কোণঠাসা “তালপাতার সেপাই”
সুজয় ঘোষাল : বাংলার লোকশিল্পের আঙিনায় এক সময়ে “তালপাতার সেপাই” ছিল একটি জনপ্রিয় খেলনা, যা শিশুমনকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করত। খেলনাটি তৈরি করতে প্রয়োজন পড়ত সামান্য কিছু শুকনো তালপাতা আর রঙ-তুলি। খুব হালকা ও পাতলা এই তালপাতার সেপাই তখন ঘুরত ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের হাতে। সেই সময়ের এই খেলনাটির অধিক জনপ্রিয়তা “তালপাতার সেপাই” শব্দটিকেই স্থায়িত্ব করে দিয়েছে বাংলা শব্দ ভাণ্ডারে। যার এখন আক্ষরিক অর্থ শীর্ণ, কৃশকায়, মেদহীন অতিশয় দুর্বল ব্যক্তি।
     কিন্তু কালের গরল স্রোতে গ্রাম-বাংলার জনপ্রিয় এই খেলানাটিও আজ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। শিশুমনকে আর পূর্বের মতো আকৃষ্ট করতে পারে না এটি। কারণ খেলনার উৎকর্ষতা বৃদ্ধিতে চলতি বাজারে এসে হাজির হয়েছে প্ল্যাস্টিকজাত বিভিন্ন খেলনার সম্ভার। তাই বর্তমানে কচিকাঁচাদের হাতে ঘুরতে দেখা যায় না আর এই তালপাতার সেপাই বাহিনীদের।
     কীভাবে তৈরি হয় এই খেলনা? তালপাতার সেপাই তৈরী করতে প্রথমে তালপাতাকে কেটে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। শুকিয়ে যাওয়ার পর খন্ড খন্ড করে কেটে মাপ ও আকার অনুযায়ী মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বানানো হয়। এরপর খন্ডগুলিকে এক এক করে যুক্ত করা হয় সুতো দিয়ে। তারপর স্কেচ পেন বা রঙ-তুলির টানে ফুটিয়ে তোলা হয় সেপাইদের চোখ, মুখ, মাথার চুল এবং দেহের অন্যান্য অংশগুলি। তবে পুরোটাই করা হয় নকশা ও অলংকরণের মাধ্যমে। সবশেষে বাঁশের কাঠি লাগিয়ে, সেই কাঠির সামান্য নড়াচড়ায় সেপাইদের হাত-পায়ের চঞ্চলতা সৃষ্টি করা হয়। তালপাতার এই পুতুলগুলিতে পুরুষ ও মহিলা উভয় সেপাই থাকে।
     তালপাতার সেপাইয়ের চাহিদা এখন বড্ড কম। তাই বাংলার এই লোকশিল্পের কারিগরও প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিন্তু বীরভূম জেলায় এখনও কিছু কারিগরের দেখা পাওয়া যায়। তাঁরা আজও তালপাতার সেপাই তৈরির সঙ্গে যুক্ত আছেন এবং তা বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন।
আধুনিক খেলনার ভিড়ে এখন অনেকটাই কোণঠাসা “তালপাতার সেপাই”
তালপাতার সেপাই ফেরী করছেন সেখ আনেশ
     বীরভূম জেলার বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লকের মহিদাপুর গ্রামে দীর্ঘদিন ধরেই এই তালপাতার সেপাই তৈরীর কাজে যুক্ত আছেন ষাটোর্দ্ধ সেখ আনেশ। তালপাতার সেপাই তৈরী সম্পর্কে তিনি জানালেন, “আমি বহুদিন ধরেই যুক্ত আছি এই লোকশিল্পের সঙ্গে। নিজেই এই খেলনা তৈরি করি। তারপর বিক্রি করতে ঘুরতে হয় বিভিন্ন গ্রাম ও মেলায়। আমি লক্ষ্য করেছি একটা সময়ে শিশুদের কাছে এই খেলনার কদর ছিল অনেক। এখন এই খেলানার প্রতি আগ্রহ বাচ্চাদের অনেক কম। তবুও গ্রামে খেলনা নিয়ে হাজির হলে তালপাতার সেপাই আজও কিছু কিছু বিক্রি হয় বইকি। কেউ একটা বা কেউ দুটো কিনে নিয়ে যায়।”
     দাদু (সেখ আনেশ)-র কাছ থেকে তালপাতার সেপাই তৈরীর কৌশল বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করে নিয়েছেন নাতি সেখ আমানুল্লা। ১৫ বছর বয়সী এই কিশোর জানালেন, “দাদুর হাতের তৈরী এই তালপাতার সেপাই নিয়ে ছোটবেলায় খেলেছি। তখনই কৌতূহল ছিল সেপাই তৈরি করার। পরে দাদুর কাছে শিখেও নিয়েছি। এখন শান্তিনিকেতনের খোয়াইয়ের হাটে প্রতি শনিবার এই তালপাতার সেপাই বিক্রি করি।” বিক্রি করে কত পান জিজ্ঞেস করাতে আমানুল্লা বললেন, “প্রতিটি সেপাই ১০-২০ টাকায় বিক্রি হয়। যা দিয়ে নিজের পড়াশুনার খরচ চালিয়ে নিই।”
আধুনিক খেলনার ভিড়ে এখন অনেকটাই কোণঠাসা “তালপাতার সেপাই”
খোয়াইয়ের হাটে তালপাতার সেপাই বিক্রি করছেন সেখ আমানুল্লা
     মহিদাপুর গ্রাম থেকে ২ কিলোমিটার দূরে রায়পুর গ্রামেও তালপাতার সেপাই তৈরী করেন বছর চল্লিশের গৌরাঙ্গ দাস। তিনি বিগত ১৪ বছর ধরে এই লোকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তিনি জানালেন, “আমার বাবা অমূল্যরতন দাস তালপাতার সেপাই বানাত। বাবার কাছেই আমি এই সেপাই তৈরীর কাজ শিখেছি”। তালপাতার সেপাইয়ের এখন চাহিদা কেমন, জিজ্ঞেস করাতে তিনি জানালেন, “চাহিদা যে একবারেই কম, তা বলা যাবে না। আমি কলকাতা সহ ব্যাঙ্গালোর, দিল্লী, গুরুগাঁও প্রভৃতি স্থানে এই তালপাতার সেপাই নিয়ে প্রর্দশনী করেছি।”
     আধুনিককালের শিশুমনে এখন প্ল্যাস্টিকজাত ও ইলেক্ট্রনিকের খেলনার চাহিদা তুঙ্গে। এর পাশাপাশি অনলাইন ভিডিও গেমসের সঙ্গে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করে তারা। স্মার্ট ফোনের দৌলতে তা আরও সহজ হয়ে উঠেছে। আর তাই ক্রমশ জনপ্রিয়তা হ্রাস পাচ্ছে “তালপাতার সেপাই”-দের। এরকম সময়ে বীরভূমের সেখ আমানুল্লা বা গৌরাঙ্গ দাসের মতো লোকশিল্পীরা আজও পুরনো এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন কোনও রকমে। তাঁদের এই সৃষ্টিসুলভ কাজ অবশ্যই বিরাট প্রশংসার দাবি রাখবে বাংলার বুকে।
Advertisement
Previous articleক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র, বিপর্যয় নামতে পারে সৃষ্টির ওপর
Next articleএকটি বিরল আকৃতির বাছুর জন্ম নিল শেরপুরে (ভিডিও সহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here