Advertisement
জনদর্পণ ডেস্ক : করোনা সংক্রমণে জর্জরিত এখন সমগ্র বিশ্ব। ভারতে এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে সারা দেশ জুড়ে চলছে ‘লকডাউন’। ‘লকডাউন’-এর বাইরে রাখা হয়েছে দেশের কৃষিকাজ ও কৃষি সামগ্রীকে। কিন্তু কৃষকদেরও সচেতন হওয়া অত্যাবশ্যক। দেশব্যাপী ‘লকডাউন’-এর এই সময়ে কৃষকদের উপযুক্ত পরামর্শ দিতে এগিয়ে এল বিশ্বভারতী, পল্লী শিক্ষা ভবনের রথীন্দ্র কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র। এই কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রটি ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদের সুপারিশে এই পরামর্শ দিচ্ছে। কি সেই পরামর্শ? রথীন্দ্র কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের অধিকর্তা ড. সুব্রত মণ্ডলজানালেন সেই ‘পরামর্শ’।
কৃষকদের জন্য পরামর্শ :
করোনা ভাইরাস নামক মহামারির ব্যাপক সংক্রমণ এমন সময়ে দেখা দিয়েছে যখন রবি মরশুমের বিভিন্ন ফসল ঘরে তোলার সময়। মাঠ থেকে এই রবিশস্য সংগ্রহ ও তা ঝাড়াই–মাড়াই করে বাজারজাত করার কাজ ইত্যাদি পুরোপুরি সময় নির্ধারিত ব্যাপার। এই বিপর্যয়ের সময়ে কৃষকদের সব রকম সতর্কতা ও সাবধানতা নিতেই হবে যাতে করে এই মহামারি ছড়িয়ে না পড়ে। এর জন্য কিছু সাধারণ ও সহজ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যেমন যে কোনও সাবান দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া, ৬০–৭০ শতাংশ অ্যালকোহল দ্রবণ দিয়ে হাত ও যন্ত্রপাতি মুছে নেওয়া, মুখে মাক্স পরা, সুরক্ষামূলক পোশাক পরা, একে অপরের থেকে নির্ধারিত দূরত্ব (১–২ মিটার) বজায় রাখা এবং সঠিকভাবে কৃষি যন্ত্রপাতি পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা। কৃষকরা ও কৃষি শ্রমিকগণ সমস্ত রকম কৃষিকাজের প্রতিটি ধাপেই এই সতর্কতামূলক আচরণবিধি ও নিরাপদ দূরত্ব অতি অবশ্যই মেনে চলবেন।
ফসল কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও সংগ্রহ :
১. এখন গম কাটার সময় আসছে এবং এর জন্য কম্বাইন্ড হারভেস্টারের রাজ্যের মধ্যে ও রাজ্যের বাইরে যাতায়াতকে লকডাউনের আওতা থেকে বাদ রাখা হয়েছে ও এর জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই যন্ত্রপাতির রক্ষণা–বেক্ষণ, সারানো বা ফসল কাটার কাজে নিযুক্ত কর্মীদের জন্য আবশ্যিক সতর্কতামূলক সুরক্ষা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে হবে।
২. রবি মরশুমে সরিষা হল দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ফসল, যা কৃষকরা এখন হয় মাঠ থেকে ফসল তুলছেন বা ঝাড়াইয়ের কাজে ব্যস্ত আছেন।
৩. জমি থেকে মুসুর, ভুট্টা বা লঙ্কা তোলার কাজ চলছে এবং ছোলাও খুব শীঘ্রই সংগ্রহ করা হবে।
৪. মাঠ থেকে আখ কাটা এই মুহূর্তে পুরোদমে চলছে এবং উত্তরের রাজ্যগুলিতে আখ লাগানোর কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে।
৫. ফসল তোলার সময় এবং তার আগে ও পরে যথোপযুক্তভাবে ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা এবং সামাজিক দূরত্বের বিষয়গুলি পালন করতে হবে।
৬. যেসব জায়গায় হাত দিয়ে মাঠের ফসল তোলা ইত্যাদি কাজগুলি করতে হবে সেখানে এই সমস্ত কাজগুলি এমনভাবে করতে হবে যাতে কর্মরত প্রতিটি মানুষের মাঝে ৪–৫ ফুট নিরাপদ দূরত্ব বজায় থাকে। এক্ষেত্রে ৪–৫ ফুট দূরে দূরে কয়েকটি সারির ফসল কাটার দায়িত্ব এক–একজনকে দেওয়া যেতে পারে, যাতে কৃষক বা কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় থাকে।
৭. মাঠে কর্মরত প্রতিটি মানুষের উচিত জীবাণুপ্রতিরোধী মুখোশ পরে কাজ করা এবং বারবার সাবান দিয়ে নিজেদের হাত ধুয়ে নেওয়া।
৮. মাঠে কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নেওয়া, খাবার খাওয়া এবং তারপরে ফসল নিয়ে যাওয়ার সময় সব ক্ষেত্রেই উচিত পারস্পারিক দূরত্ব নিরাপদ সীমার মধ্যে(৪–৫ ফুট) রাখা।
৯. মাঠে কাজ করার সময় যতটা সম্ভব ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করতে হবে। একই দিনে অধিক সংখ্যক লোককে কাজে নিযুক্ত না করাই ভালো।
১০. এই সময়ে যথা সম্ভব পরিচিত মানুষজনকেই মাঠের কাজে নিযুক্ত করাই ভালো, এতে করে সম্ভাব্য করোনা ভাইরাস জীবাণু বহনকারী কোনও মানুষের থেকে মাঠে নিযুক্ত অন্যান্য লোকের মধ্যে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা এড়ানো যাবে।
১১. হাতে করে ফসল কাটার চাইতে যন্ত্রের সাহায্যে ফসল কাটাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যন্ত্র চালানোর জন্য যে ক’জন লোকের প্রয়োজন কেবলমাত্র সে’জনকেই এই কাজে লাগাতে হবে।
১২. ফসল কাটার যন্ত্রগুলিকে প্রবেশ পথে নিয়মিতভাবে জীবাণু মুক্ত করতে হবে। ফসল বা উৎপাদন সামগ্রী বহন করার গাড়ি এবং বস্তাবন্দি করার যন্ত্র, বস্তা ও অন্যান্য প্যাকেজিং সামগ্রীও জীবাণু মুক্ত করতে হবে। ফসল তোলার সময় তা ৪–৫ ফুট দূরে দূরে ছোটো ছোটো স্তূপ করে এক–একটি স্তূপের দায়িত্ব ১–২ জনকে দেওয়া যেতে পারে।
১৩. ভুট্টা ও চিনা বাদাম ঝাড়নের যন্ত্রগুলিকে বিশেষ করে যেগুলি বিভিন্ন কৃষকগোষ্ঠী দ্বারা ব্যবহৃত হয়, সেগুলিকে উপযুক্তভাবে পরিষ্কার ও জীবাণু মুক্ত করতে হবে। মেশিনের যে সমস্ত যন্ত্রাংশ বারবার হাত দিয়ে ব্যবহার করা হয়, সেগুলিকে সাবান জল দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
ফসল তোলা, গুদামজাত করণ এবং বাজারজাত করার সময়ে সতর্কতা :
১. কৃষি খামারে ফসল শুকানো, ঝাড়াই–মাড়াই, পরিষ্কার করা এবং প্যাকেজিং–এর বিভিন্ন স্তরে যাতে করে শ্বাসনালীতে ধুলো এবং এরোসেল প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট ঘটাতে না পারে সে জন্য মুখে মাক্স ব্যবহার করতে হবে।
২. শস্যের গুদামজাত করার আগে সেগুলিকে ভালোভাবে শুকিয়ে নেওয়া দরকার। গুদামের পোকা যাতে আক্রমণ না করে সে জন্য পুরনো বস্তা ব্যবহার করা উচিত নয়। চটের বস্তাকে ৫ শতাংশ নিম দ্রবণে ডুবিয়ে শুকিয়ে নিয়ে ব্যবহার করলে ভালো হয়।
৩. ভবিষ্যতে ফসলের ভালো দাম পাওয়ার সম্ভাবনাকে সুনিশ্চিত করতে এবং খামারে উৎপাদিত শস্যকে যাতে পূর্ণমাত্রায় গুদামজাত করা যায়, সে জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যায় চটের বস্তা মজুত আছে কিনা তা আগেভাগেই দেখতে হবে।
৪. বাজার/মাণ্ডি-তে বিক্রি করার সময় যখন গাড়িতে তোলা হবে এবং নিয়ে যাওয়া হবে, তখন উপযুক্তভাবে ব্যক্তিগত স্তরে জীবাণু প্রতিরোধী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. যে সমস্ত কৃষকরা বীজ উৎপাদন করছেন তাঁরা বীজ বিক্রয়ের জন্য উপযুক্ত নথিপত্রসহ বীজ বিক্রেতা কোম্পানিতে নিয়ে যেতে পারবেন। বিক্রয়মূল্য গ্রহণের সময়ও তাঁদের উপযুক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬. বীজ উৎপাদনকারী রাজ্যগুলি থেকে বীজ প্রক্রিয়াকরণ এবং প্যাকেজিং করে বীজ ব্যবহারকারী রাজ্যগুলিতে পরিবহণ হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যাতে করে পরবর্তী খরিফ মরশুমে বীজের যোগান অক্ষুণ্ণ থাকে, যেমন সবুজ গোখাদ্যের বীজ যা উত্তরের রাজ্যগুলিতে এপ্রিল মাসে বোনা হয় তা দক্ষিণের রাজ্যগুলি থেকেই আসে।
৭. মাঠ থেকে বিভিন্ন শাক-সবজি যেমন টম্যাটো, ফুলকপি, বিভিন্ন ধরণের শাক, শসা, লাউ, কুমড়ো ইত্যাদি সরাসরি বাজারজাত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
বর্তমানে মাঠে থাকা ফসল সমূহ :
১. যে সমস্ত এলাকায় গম চাষ হয় সেখানকার তাপমাত্রা দীর্ঘমেয়াদি গড় তাপমাত্রা থেকে এখনও বেশ অনেকটা নিচে। যার ফলে গম কাটা ১০-১৫ দিন পিছিয়ে এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত করলেও ফসলের উৎপাদন খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এতে কৃষকরা ঝাড়াই-মাড়াই করে বাজারজাত করার জন্য বাড়তি অনেকটা সময় পাবেন।
২. বোরো ধান এখন দানার পুষ্টি দশায় আছে। এই সময় ঝলসা (নেক ব্লাস্ট) রোগের আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এর জন্য বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ করা নির্দিষ্ট ছত্রাকনাশক যেমন ট্রায়াজোল বা স্ট্রবিলিউরিন স্প্রে করা যেতে পারে।
৩. পাকা ধান মাঠে থাকা অবস্থায় যদি অসময়ে বৃষ্টি হয় তাহলে গাছেই দানার অঙ্কুরোদগম (কল হওয়া) আটকাতে ৫ শতাংশ লবণজল স্প্রে করা যেতে পারে।
৪. আম গাছে এখন মুকুল থেকে গুটি ধরছে। এই অবস্থায় স্প্রে করে সার বা শস্য সুরক্ষার জন্য কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করার সময় বিভিন্ন সামগ্রী বহন করা, মেশানো এবং যন্ত্রপাতি ধুয়ে পরিষ্কার করার সময় প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
৫. গ্রীষ্মকালীন ডালশস্য যেমন মুগ ইত্যাদিতে সাদা মাছির আক্রমণ ও তার ফলে হলুদ মোজেয়িক ভাইরাস রোগ হতে পারে। এক্ষেত্রেও নিজেদের সুরক্ষা সাবধানতা অবলম্বন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
গো পালনের ক্ষেত্রে পরামর্শ :
১. দুধের কম চাহিদার কারণে চাষি বন্ধুরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তাই দুধ না ফেলে দিয়ে দোয়া দুধ গো খাদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে গরুকে খাওয়াতে পারেন। ১০ লিটার দুধ প্রায় ১ কেজি গো খাদ্যের পরিপূরক।
২. ২ লিটার দুধ ৫ কেজি গো খাদ্যের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো যায়। এতে করে ২০০ গ্রাম গো খাদ্য বাঁচবে এবং পরবর্তীকালে গরুকে খাওয়ানো যাবে।
৩. অতিরিক্ত দুধ নষ্ট না করে ঘি তৈরি করে মজুত রাখুন।
- All Rights Reserved
Advertisement