কিম জং উন কি সত্যিই মৃত? ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে রহস্য!

Advertisement
kim
সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : সারা বিশ্বে যখন করোনার অতিমারি সংবাদের শিরোনামে রয়েছে। তখন ছোট্ট একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের শারীরিক খবর জানার জন্য সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলো মুখিয়ে আছে। তিনি বিখ্যাত কেউ নন, তবে কুখ্যাত অবশ্যই। বিশ্বের সবচেয়ে সাড়া জাগানো উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক কিম জং উন।
     পরমাণু শক্তিধর এই ছোট্ট দেশটি বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হলেও সামরিক দিক থেকে সে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি। প্রতিবছর সামরিক খাতে এই দেশটি ব্যয় করে তার জিডিপির এক-চতুর্থাংশ। তার হাতে আছে আইসিবিএম (ICBM)-এর মতো সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র। যা আমেরিকার যে কোন শহরকে এফোঁড়ওফোঁড় করতে সক্ষম। তার ওপর তার হাতে আছে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ বিভিন্ন ধরণের মারাত্মক রাসায়নিক অস্ত্রশস্ত্র।
kim2
সেনাবাহিনীর সঙ্গে কিম জং উন (ছবি : সংগৃহীত)
     এহেন দেশের সামরিক শাসক কিম জং উন কে সমঝে চলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। সব রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করেও আমেরিকা তাকে বাগে আনতে পারেনি। অতঃপর আলোচনা। কিন্তু সেই আলোচনাও ফলপ্রসূ হয়নি কিমের একগুঁয়ে মনোভাবের জন্য।
     গত ১৫ এপ্রিল উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম জং এর দাদু কিম উল সুং এর জন্মদিন ছিল। এই দিনটি উত্তর কোরিয়ায় জাতীয় দিবসের মতো মহাসমারোহে পালিত হয়। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিবছর দাদুকে সম্মান জানাতে এই বিশেষ দিনটিতে উপস্থিত থাকেন কিম জং উন। কিন্তু এবার তিনি অনুপস্থিত। ঠিক এখান থেকেই জল্পনা-কল্পনা পাখা মেলতে শুরু করেছে।
kim4
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কিম জং উন (ছবি : সংগৃহীত)
     বিভিন্ন সংবাদ সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, গত ১১ এপ্রিল কিমের হৃদপিন্ডের একটি ভালবে অস্ত্রোপচার হয়। তারপর থেকেই গত ২ সপ্তাহ ধরে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। এমনিতে উত্তর কোরিয়ার সামরিক রাষ্ট্রের লৌহ কপাটের অন্তরাল থেকে কোন সংবাদ সংগ্রহ করা রীতিমতো দুঃসাধ্য। কিমের সামরিক গোয়েন্দারা সদা তৎপর যাতে দেশের কোন সংবাদ বাইরে না যেতে পারে। সামান্য সন্দেহ হলেই সন্দেহভাজনের প্রাণ নিতে বিন্দুমাত্র সময় নেন না কিম। নিজের ভাই কিম জং নাম কে পর্যন্ত ছাড়েননি। কিমের পাঠানো মহিলা গুপ্তঘাতকের হাতে ভিএক্স নার্ভ এজেন্ট নামক রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগে কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নামনিহত হন।
     তাই জল্পনা-কল্পনা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি নিউজ অ্যাপস সূত্রে যে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে অস্ত্রোপচারের পর কিম নাকি গভীর কোমায় চলে গেছেন। একজন ফরাসি চিকিৎসক নাকি তাকে পর্যবেক্ষণ করে কোমা থেকে ফেরার আর কোন সম্ভাবনা নেই বলে ঘোষণা করেছেন। সম্প্রতি জানা গেছে, তার চিকিৎসকদের পরামর্শ দেবার জন্য চীন থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দল পিয়ংইয়ংয়ে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে নাকি একজন করোনা আক্রান্ত ডাক্তার ছিল তার থেকে কিমও নাকি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
kim5
চিনা প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং-এর সঙ্গে কিম জং উন (ছবি : সংগৃহীত)
     চিকিৎসক দলটি চীনে ফিরে গেলেও কোন সংবাদের সত্যতা তাদের মুখ থেকে এখন পাওয়া যায়নি। সম্ভবত পাওয়া যাবেও না।
     ৩৬ বছর বয়সী কিম সাংঘাতিক রকম চেইন স্মোকার তার সাথে প্রচুর মদ্যপান করেন। দামি ফরাসি মদ ও কিং সাইজ সিগারেট আসে ইউরোপ থেকে। তার ওপর তিনি আবার অত্যন্ত মেদবহুল। তাই হৃদপিন্ডের গোলযোগ তার ছিল। সেই সঙ্গে তিনি অত্যন্ত ভোজন রসিক, কোন স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা করেন না। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি ওয়েবসাইট দাবি করছে, সমস্ত সংবাদ ভ্রান্ত কিমের অস্ত্রোপচার হলেও তার অবস্থা স্থিতিশীল।
     তবু নানা ধরনের সংবাদ সংবাদমাধ্যমে উড়ে বেড়াচ্ছে। কয়েকদিন আগে মার্কিন সংবাদপত্রগুলিতে দাবি করা হয়েছিল, কিমের অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। হংকংয়ের একটি সাইট থেকে দাবি করা হয়েছে, কিম জং উন আর বেঁচে নেই। তবে সারা পৃথিবীর তাবৎ শক্তিধর রাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগও বসে নেই। চীন কিংবা দক্ষিণ কোরিয়া বিষয়টি নিয়ে সরকারিভাবে মুখ না খুললেও। গোয়েন্দা উপগ্রহের মাধ্যমে নজরদারি চালানো হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার ওপরে। জানা গেছে বিমান পরিবহন ব্যবস্থায় এখন তেমন কোন গোলমাল নজরে পড়েনি। নামেনি কোন এয়ার অ্যাম্বুলেন্সও।
     একথা সর্বজনবিদিত যে চীন ও রাশিয়া কিম জং উনকে রীতিমতো মদত দেয়। প্রতিদিন যেমন গড়ে আধ ডজন আন্তর্জাতিক উড়ান পিয়ংইয়ংয়ে নামে, তেমনি নামছে বলে জানা গেছে। তাছাড়া স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণে আরও জানা গেছে, কিমের প্রাসাদ সংলগ্ন যে ব্যক্তিগত হাসপাতালটি ছিল,সেটি সম্প্রতি ভেঙে ফেলা হয়েছে। এর কারণ অবশ্য জানা যায়নি। আরেকটি মার্কিন উপগ্রহের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার পূর্ব উপকূলে চীন সীমান্তের অদূরে অবস্থিত রিসর্ট শহর উনসানে গত ২৩ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার কিমের ব্যক্তিগত ছোট্ট ট্রেনটিকে তার ব্যক্তিগত রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। কিম সাধারণত গাড়ি বা বিমানে চড়তে ভয় পান। প্রাণ হারানোর ভয়ে, তার প্রিয় বাহন হল ট্রেন। যে কোন জায়গায় গেলে তিনি একটি আস্ত ব্যক্তিগত ট্রেন ব্যবহার করেন। যদিও উনসানে রয়েছে একটি ব্যক্তিগত ছোটো বিমান বন্দর।
     যাইহোক, উনসানে কিমের একটি নিভৃতাবাস আছে। নিন্দুকেরা বলে থাকেন,দেশের অভ্যন্তরে কোনরকম ক্যু হলে এখান থেকে সহজেই চীনে পালিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করে রেখেছেন কিম।
     প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উনসান থেকেই উত্তর কোরিয়া তার মিসাইল পরীক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সামরিক বিশেষজ্ঞরা আন্দাজ করছেন, কিম সম্ভবত কোনরকম মিসাইল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাই হঠাৎ এই অজ্ঞাতবাস। কারণ এমনটা আগেও হয়েছে।
     এরই মধ্যে রাজনৈতিকক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পট পরিবর্তন হয়েছে, সেটিও পর্যবেক্ষকদের নজরে এসেছে। সেটি হল কিমের পর তার বোন কিম ইয়ো জং হলেন উত্তর কোরিয়ার দ্বিতীয় শক্তিশালী ব্যক্তি (মহিলা)। তাকে আকস্মিকভাবে সর্বোচ্চ পলিটব্যুরোর সদস্য করা হয়েছে। সম্ভবত কিমের অবর্তমানে তাকে যাতে উত্তর কোরিয়ার কর্ণধার বানানো যায় সেই বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রেখে। বাস্তবিক তেমনটা হলে তিনিই হবেন উত্তর কোরিয়ার প্রথম মহিলা স্বৈরশাসক। ক্রুরতা এবং কঠোরতার দিক থেকে তিনিও তার দাদার সার্থক উত্তরসূরী হতে পারবেন বলে অনেকেই মনে করেন।
kim3
নিজের বোন কিম ইয়ো জং-এর সঙ্গে কিম জং উন (ছবি : সংগৃহীত)
     কিন্তু এসব কিছুই জল্পনা-কল্পনা। কারণ উত্তর কোরিয়ার একটি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৪ সালেও কিম একবার মাসখানেকের জন্য অদৃশ্য হয়েছিলেন। সেবারও হাওয়ায় উড়ে ছিল তার মৃত্যুর সংবাদ। শেষ পর্যন্ত জানা যায় তিনি অ্যঙ্কেলে চোট পাওয়ায় কিছুদিন চিকিৎসার জন্য বিশ্রামে ছিলেন।
     এখন সত্যিই যদি কিমের মৃত্যু হয়ে থাকে, তাহলে পরমাণু শক্তিধর দেশটিতে ক্ষমতা দখল নিয়ে সংকটজনক পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য আমেরিকা, চীন, রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার ওপর শ্যেন দৃষ্টি রেখে চলেছে। সম্ভবত এই তিনটি বৃহৎ শক্তি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ায় আছে। তাই সঙ্গত কারণেই এখন এদের মুখে কুলুপ। দক্ষিণ কোরিয়াও অত্যন্ত সতর্ক আছে এখন পর্যন্ত তাই কোন প্রতিক্রিয়া দেয়নি। কাজেই কিম জং উনের শেষ পরিণতি জানার জন্য বিশ্ববাসীকে আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কেন না এখন পর্যন্ত কিমের নামেই দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দপ্তরের সমস্ত কাজকর্ম পরিচালিত হচ্ছে।
  • All rights reserved
Advertisement
Previous articleমাত্র দুই পয়সা নিয়ে জমিদারি শুরু করেছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ (ভিডিও সহ)
Next articleলকডাউনে আটকে থাকা অসহায় শিক্ষার্থীকে সাহায্য করলেন শিক্ষিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here