শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্ ও স্বামী বিবেকানন্দ

Advertisement
Final
দেবকুমার দত্ত : এ কথা বলা যেতে পারে – সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অধ্যাত্মচেতনার জগতে প্রবেশের জন্য নরেন্দ্রনাথের বিশ্বস্ত চাবিকাঠি সংগীত সংগীতের ব্যাপক ক্ষেত্র যেমন রচনা, অনুশীলন, সংকলন, পর্যালোচনা ও পরিবেশন সংগীতের হাত ধরেই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সঙ্গে নরেনের পরিচয় সিমলায় ডস্ট কোম্পানির মুৎসুদ্দি সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে ৬ নভেম্বর, ১৮৮১ রবিবার নরেন্দ্রনাথ সেদিন দুটি বিখ্যাত ব্রাহ্মসংগীত, ‘মন চল নিজ নিকেতনে…’ (অযোধ্যানাথ পাকড়াশী রচিত) যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে…’ (বেচারাম চট্টোপাধ্যায় রচিত) উদাত্ত কণ্ঠে রামকৃষ্ণদেবকে গেয়ে শোনালেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে নরেন্দ্রনাথ দত্ত রামকৃষ্ণদেবের পবিত্র সংস্পর্শে এসে অধ্যাত্মলোকের প্রাথমিক স্বাদ পেলেন
     সংগীতের সূত্রে খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের বাংলারপদ্মাবতীচরণচারণচক্রবর্ত্তীজয়দেব ও তাঁর অমর কাব্য তথামঙ্গলমুজ্জ্বলগীতিশ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্এর সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের পরিচয় হয় ১৮৮৭ সালের আগস্টসেপ্টেম্বর মাসে বৈষ্ণবচরণ বসাকএর সঙ্গে যৌথ প্রয়াসে নরেন্দ্রনাথ সঙ্গীতকল্পতরু নামে ৬৪৭টি সংগীতের একটি অনবদ্য সংগ্রহসংকলন প্রকাশ করেছিলেন তখন নরেন্দ্রনাথের বয়স ২৪ বছর মাত্র এই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ সংকলন গ্রন্থে নরেন্দ্রনাথ জয়দেবের শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্ থেকে তিনটি গীত অন্তর্ভুক্ত করলেন সেগুলি হল, ‘প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদং’, ‘বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচিকৌমুদীরতিসুখসারে গতমাভিসারে মদনমনোহরবেশম্ এই গীতগুলির রচয়িতা হিসাবে জয়দেব গোস্বামীর নাম মুদ্রিত আছে
     এ বার আমরা এই তিনটি গীত সম্পর্কে একটু ধারণা পেতে পারি জয়দেব গোস্বামী বিরচিত শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্এর প্রথম সর্গ(সামোদদামোদরঃ)-এর প্রথম গীত হলপ্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদং সঙ্গীতকল্পতরু গ্রন্থেবিবিধধর্ম্মসঙ্গীতপর্যায়েদশ অবতারের স্তবশীর্ষকে এই গীতটি সম্পূর্ণরূপে মুদ্রিত হয়েছে এই গীতটি মাধব রাগ ও রূপক তালে নিবদ্ধ গ্রন্থের প্রারম্ভে গুরুবন্দনা বা স্বস্তিবচনের মতো কবি জয়দেব এই দশাবতার স্তোত্রের অবতারণা করেছেন। বিভিন্ন হিন্দু-পুরাণে স্তবের উল্লেখ থাকলেও দশঅবতার বিভিন্ন নামপরিচয়ে হাজির এই দশাবতার বন্দনার শেষ শ্লোকে কবি জয়দেব লিখেছেন – ‘বেদানুদ্ধরতে জগন্তি বহতে ভূগোলমুদ্ধিভ্রতে / দৈত্যান্ দারয়তে বলিং ছলয়তে ক্ষত্রক্ষয়ং কুর্ব্বতে / পৌলস্ত্যং জয়তে হলং কলয়তে কারুণ্যমাতন্বতে / ম্লেচ্ছান্ মূর্চ্ছয়তে দশাকৃতিকৃতে কৃষ্ণায় তুভ্যং নমঃ।।
     কবি জয়দেব ও শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্ গ্রন্থে শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এই শ্লোকটির অনুবাদ করেছেন, ‘বেদের উদ্ধারকারী, ত্রিলোকের ভারবহনকারী, ভূমণ্ডল উত্তোলনকারী, হিরণ্যকশিপু বিদারণকারী, বলিকে ছলনাকারী, ক্ষত্রক্ষয়কারী, দশাননসংহারকারী, হলকর্ষণকারী, করুণাবিতরণকারী, ম্লেচ্ছধ্বংসকারী, দশরূপধারী হে কৃষ্ণ, তোমায় প্রণাম করিঅর্থাৎ মৎস্য বীভৎস, কুর্ম অদ্ভুত, বরাহ ভয়ানক, নৃসিংহ বাৎসল্য, বামন সখ্য, পরশুরাম রৌদ্র, রামচন্দ্র করুণ, হলধর হাস্য, বুদ্ধদেব শান্ত ও কল্কি বীররসের অধিষ্ঠাতা হিসাবে পূজিত বিষ্ণুর এই অবতার হিসাবে পৃথিবীতে অবতরণকে অলৌকিকতার মোড়ক ছাড়িয়ে দেখলে মানবচরিত্রের উৎকর্ষের সন্ধান মেলে মানবাত্মার পূর্ণ বিকাশে এই গুণগুলির স্বীকৃতি দিয়েছেন নরেন্দ্রনাথ ও পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ
     বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচিকৌমুদীগীতটি শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্এর দশম সর্গ(মুগ্ধমাধবঃ)-এর অন্তর্গত এই গীতটি শ্রীহরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় লিখিত পূর্বোক্ত গ্রন্থে দেশবরাড়ী রাগ ও অষ্টতালী তালে নিবদ্ধ সঙ্গীতকল্পতরু গ্রন্থে গীতটির প্রথম দিককার আটটি শ্লোক গ্রথিত হয়েছে এবং শিরোদেশে রাগের উল্লেখ আছে লেখকজয়দেব গোস্বামী তাঁর গানের খাতায় ৪৫৪৬ পৃষ্ঠায় পেন্সিলে এই গীতটির প্রথম তিনটি শ্লোক ও স্বরলিপি স্বামীজি লিখে গেছেন শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্এর ১৯সংখ্যক এই গীতটির শ্লোকক্রম তথা বিন্যাসে নরেন্দ্রনাথ একটু স্বাধীনতা নিয়েছেন
     শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্এর পঞ্চম সর্গের বিষয়য়ানুগ পরিচয় : ‘সাকাঙ্ক্ষপুণ্ডরীকাক্ষঃ’। এই সর্গের অন্তর্গত মাত্র দু’টি গীত। দ্বিতীয় তথা শেষ গীতটি ‘গুর্জ্জরীরাগ’ ও একতালে নিবদ্ধ – ‘রতিসুখসারে গতমাভিসারে মদনমনোহরবেশম্’। এই গীতটির পরম্পরা মেনে নয়টি শ্লোক সঙ্গীতকল্পতরু-তে সংকলিত হলেও দ্বিতীয় শ্লোকটির দ্বিতীয় চরণ ‘পীনপয়োধরপরিসরমর্দ্দনচঞ্চলকরযুগশালী’ নরেন্দ্রনাথ বাদ দিয়েছেন। কারণ স্পষ্ট।
jyro
শিল্পীর চোখে কবি জয়দেব (ছবি : সংগৃহীত)
     এ ছাড়াও প্রথম সর্গের ৪-সংখ্যক গীতের (‘চন্দনচর্চ্চিতনীলকলেবরপীতবসনবনমালী’) মাত্র দু’টি চরণ তাঁর গানের খাতার ৪৭ পৃষ্ঠায় পেন্সিলে স্বরলিপি সহ স্বামীজি লিখেছেন। কবি জয়দেবের মতে এই গীতটি রামকিরী রাগ ও যতিতালে নিবদ্ধ। লক্ষ করার বিষয় এই যে সঙ্গীতকল্পতরুগীত-সংকলনে এই গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
     নরেন্দ্রনাথ ও পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দের এই গীতগোবিন্দ-প্রীতি সর্বতোভাবে আন্তরিক। দীর্ঘকাল আমেরিকা ও ইউরোপে থাকার দরুন সংস্কৃত সাহিত্য ঠিকমতো আস্বাদন করার সুযোগ তিনি পেতেন না। তবে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ কণামাত্র কমেনি। স্বামী অখণ্ডানন্দ তাঁর স্মৃতিকথা (১৯৮৩) গ্রন্থে লিখেছেন : “অবিরত ইংরেজি বক্তৃতা দিয়া ও ইংরেজি কথাবার্তা কহিয়া স্বদেশে ফিরিয়া তাঁহার মুখে সে সময়ে গীতগোবিন্দের গান লাগিয়াই থাকিত। ‘নামসমেতং কৃতসঙ্কেতং বাদয়তে মৃদু বেণুম’ ইত্যাদি মৃদু মধুর স্বরে গুনগুন করিয়া গাহিতে গাহিতে স্বামীজি অনেক সময় আত্মহারা হইয়া থাকিতেন।” এই অংশটি শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্এর পঞ্চম সর্গের একাদশ গীতের দশম শ্লোকের পূর্বাংশ বিশেষ। আমাদের এই ভাবনা-চিন্তা তাই অমূলক নয় যে জয়দেব গোস্বামী ও শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্ কাব্যটি স্বামী বিবেকানন্দের অন্তর-সত্তার আনন্দ-সম্পদ। ড. সুবোধ চৌধুরী তাঁর রামকৃষ্ণ–বিবেকানন্দসাহিত্য গ্রন্থে লিখেছেন, “(বিবেকানন্দ) ১৮৮৮-তে গীতগোবিন্দ-এর অনুবাদ করেছিলেন। এটি সাহিত্য কল্পদ্রুম নামক মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।”
     মাস্টারমশাই শ্রীম তথা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-কার মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের আদেশে স্বামী বিবেকানন্দের গৃহী শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী স্বামীজির ‘উদ্দীপনাময় বহু কথা’ তাঁর স্বামী-শিষ্য-সংবাদ (১৯১২) গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে গোপাললাল শীলের কাশীপুর বাগানবাড়িতে সন্ধ্যার পর স্বামীজি অনেকানেক কথা প্রসঙ্গে জয়দেব ও শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্এর কথা তুললেন। স্বামীজি বললেন, ‘জয়দেব সংস্কৃত ভাষার শেষ কবি।’ ঠিক তার পরপরই এসে গেল কাব্যের পর্যালোচনা। শিষ্য শরচ্চন্দ্রকে বিবেকানন্দ বললেন, ‘তবে জয়দেব ভাবাপেক্ষা অনেক স্থলে jingling words (শ্রুতিমধুর শব্দবিন্যাস)-এর দিকে বেশি নজর রেখেছেন।’ স্বামীজি আরও বলেছেন – ‘দেখ দেখি – গীতগোবিন্দের “পততি পতত্রে” ইত্যাদি শ্লোকে অনুরাগ-ব্যাকুলতার কি culmination (পরাকাষ্ঠা) কবি দেখিয়েছেন! আত্মদর্শনের জন্য ঐরূপ অনুরাগ হওয়া চাই। প্রাণের ভেতরটা ছটফট করা চাই।’
     বিবেকানন্দের জীবনে যেমন আলোর নাম শ্রীরামকৃষ্ণ, তেমনি অধ্যাত্মব্যাকুল সংগীতময় আত্মনিবেদনের নাম শ্রীশ্রীগীতগোবিন্দম্
Advertisement
Previous article“ফিমেল” শুধু গল্প নয়, এ যেন এক জীবনের কথা
Next articleপ্রথম প্রয়োগ হল করোনার ভ্যাকসিন, এখনও পেরোতে হবে বহু পথ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here