Advertisement
সজয় পাল : চিনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া মারণ ভাইরাস কোভিড–১৯–এর থাবায় এখন সমগ্র বিশ্বই আতঙ্কে প্রহর গুনছে। ১৮৮টি দেশের প্রায় ৩ লক্ষ ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ এই ভাইরাসে বর্তমানে আক্রান্ত। তার মধ্যে মারা গিয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। চিনের পাশাপাশি এই ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ইতালি, স্পেন, আমেরিকা, জার্মানি, ইরান। চিনের থেকেও ভয়াবহ পরিস্থিতি এখন ইতালির।
কিন্তু অবাক করা ব্যাপার, এই দেশগুলির প্রত্যেকটিই চিন থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। চিন সীমান্তের সঙ্গে এদের কোনও সংযোগও নেই। অথচ ভারত বা রাশিয়া উভয় দেশই চিন সীমান্তে অবস্থান করার পরেও করোনা সংক্রমণ এখনও যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
রাশিয়ার সঙ্গে চিনের সীমান্ত সংযোগ প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটারের। চিন ও রাশিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থাও যথেষ্ট উন্নত। প্রায় প্রতিদিনই এই দুই দেশ নিজেদের মধ্যে লোক চলাচল অব্যাহত রাখে। অথচ রাশিয়ায় বর্তমানে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪৩৮ জন। তার মধ্যে মৃত্যু ঘটেছে মাত্র ১ জনের।
এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে, রাশিয়া কিভাবে এখনও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, চিনে প্রথম করোনায় আক্রান্ত হয় ডিসেম্বরের শেষের দিকে। তারপর এই ভাইরাস ক্রমশ চিনের উহান প্রদেশের সর্বত্র মহামারির আকার নিতে সময় নেয় জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত। রাশিয়া ব্যাপারটি মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। তারা ৩০ জানুয়ারিতেই চিনের সঙ্গে সীমান্ত সংযোগ বন্ধ করে দেয়। তারপরই কিছু এলাকা কোয়ারেন্টাইনের জন্য দ্রুত তৈরি করে ফেলে। এরপর শুরু করে করোনা সংক্রমণ পরীক্ষা। এই ব্যবস্থাও রাশিয়া ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই শুরু করে দেয়।
কিন্তু রাশিয়া একটি পদক্ষেপ নিতেই ভুল করেছিল, সেটি হল ইউরোপের সঙ্গে সংযোগ বন্ধ করতে দেরি করে ফেলা। বিশেষ করে ইতালি থেকে আগত পর্যটকদের তারা করোনা সংক্রমণ পরীক্ষার আওতাতেই রাখেনি। আর এই ভুলেই তাদের দেশে প্রথম আঘাত হানে করোনা। যদিও রাশিয়া এখনও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রনেই রেখেছে। তার জন্যে তাদের দ্রুত পদক্ষেপকেই কুর্নিশ জানাতে হয়।
কিন্তু অপরদিকে ইতালির অবস্থা ক্রমশই খারাপ থেকে খারাপ হয়ে চলেছে। তার অন্যতম কারণ সেদেশের উদাসীনতা। ইতালিতে প্রথম করোনায় আক্রান্ত হয় ১৫ ফেব্রুয়ারি। এখানেও অবাক হতে হয়। কারণ ওই সময়ে চিনের উহান প্রদেশ ছাড়া অন্য প্রদেশগুলিতে তেমনভাবে করোনা ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়নি। অথচ ওই একই সময়ে ইতালিতে পৌঁছে গিয়েছিল করোনা।
করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরও ইতালির সরকার ক্রমশই উদাসীনতা দেখিয়ে গিয়েছে। তেমন গুরুত্ব দিতে চাইনি। দেশটিতে করোনায় প্রথম মৃত্যু ঘটে ২৭ ফেব্রুয়ারি। তারপরও ভ্রূক্ষেপ করেনি সরকার। নেয়নি কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাও। কিন্তু টনক নড়ে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ততদিনে করোনায় আক্রান্ত হন ইতালির ডেমোক্রেটিক পার্টির সেক্রেটারি নিকোলা জিঙ্গোরাত্তি। কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না। দেশটির গভীর থেকে গভীরে বন্যার জলের মতো দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে করোনা। আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয় প্রায় ৬ হাজারের ওপর।
তারপরেও দেশটি ব্যাপারটির দিকে গুরুত্ব না দিয়ে ধীরে ধীরে এবং ধাপে ‘লকডাউন’ করতে থাকে। সেদেশে প্রথম দিকে একই সাথে যদি পুরো দেশের গুরুত্বপূর্ণ জনপদগুলিকে ‘লকডাউন’ করে দিত, তাহলে হয়তো এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত না। বর্তমানে ইতালিতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজারের কাছে। মৃত্যুতেও অনেক আগে ছাড়িয়ে গিয়েছে চিনকে। মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ৪৭৬ জন।
ইতালির মতো আমেরিকা, স্পেন, ফ্রান্স, ইরানেরও কিছুটা একই অবস্থা। করোনায় প্রথম আক্রান্ত হওয়ার পরপরই গুরুত্ব না দেওয়ার ফল আজ তারা ভোগ করছে।
কিন্তু ভারত হয়তো এই পরিস্থিতির মধ্যে নাও পড়তে পারে। কারণ কেন্দ্র সরকার ও দেশের সমস্ত রাজ্য সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে অনেক আগে থেকেই করোনার মোকাবিলা করতে শুরু করে দিয়েছিল। নজর রাখছিল অন্য আক্রান্ত দেশগুলির গতিপ্রকৃতির ওপর।
ভারতে প্রথম করোনায় আক্রান্ত হয় কেরালা। তারপরই গোটা দেশ দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। তবে মানতেই হবে, ভারতের মতো ১৩০ কোটির দেশে খুব দ্রুত একই সাথে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়াও সমস্যার। দেশের এক বিশাল অঙ্কের মানুষ এখনও দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নিলে ওই সব মানুষের জীবন আর্থিক দিক থেকে বিপন্ন হতে পারে। তাই ভারত সরকার ধাপে ধাপে পরিকল্পনা মাফিক ব্যবস্থা নিতে শুরু করে।
প্রথমেই দিল্লি, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব আর কেরালার গুরুত্বপূর্ণ জনপদকে‘লকডাউন’ করে দেয়। তারপর ২২ মার্চ সমগ্র ভারতেই ‘জনতা–কারফিউ’ জারি করে। আর এরপরই সমগ্র ভারত জুড়ে একই সাথে ‘লকডাউন’ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারত সরকারের এই পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখবে।
একই সঙ্গে সমগ্র দেশ জুড়ে‘লকডাউন’ করার ফলও মিলতে পারে খুব ভালোই। কারণ সমগ্র দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করার অর্থ হল সামাজিক মেলামেশা সাময়িক বন্ধ হয়ে যাওয়া। বলতে গেলে কেউই কারও সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা একেবারেই কমে যাওয়া। আর যেহেতু করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সবাই–ই দেশ বা রাজ্যের বাইরে থেকে আগত, তাই এই পদক্ষেপে দেশ বা রাজ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়া বা আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা কম হতে বাধ্য।
যদিও এ সবটাই নির্ভর করছে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর। করোনা সংক্রমণ আটকাতে সরকার যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে যদি দেশের সাধারণ মানুষ এক যোগে সহযোগিতা করে, তাহলেই সম্ভব করোনার বিরুদ্ধে জয়লাভ করার। সেই সঙ্গে অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে কেন্দ্র সরকার ও রাজ্য সরকারের নির্দেশনামা। এখনও পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৪৬৭ জন। তার মধ্যে মারা গিয়েছে ৯ জন।
- All Rights Reserved
Advertisement