ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে শুশুনিয়ার পাথর শিল্প

Advertisement
1
বিদিশা মিত্র : ভারতবর্ষে প্রস্তর শিল্পের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। মৌর্য ও গুপ্ত যুগে প্রস্তর নির্মিত স্তূপ, মন্দির, ভাস্কর্য দেখলে তা সহজেই অনুমান করা যায় এছাড়া মুঘল যুগের স্থাপত্যভাস্কর্য আজও বিস্ময় সৃষ্টি করে সে সময়ে শাহাজাহানের নির্মিত শ্বেতপাথরের তাজমহল আজও অবাক করে পৃথিবীর মানুষকে। এই তাজমহলকেই বর্তমানে বিশ্বের সপ্তমাশ্চর্যের অন্যতম আশ্চর্য রূপে গণ্য করা হয়েছে
     যাইহোক, এখন আর মৌর্য, গুপ্ত বা মুঘল যুগ নেই তাই পাথর দিয়ে শিল্পীদের কলাকৌশলের দিনও ফুরিয়েছে তবে কয়েক দশক আগেও গৃহস্থলীতে পাথরের থালা, বাটি, গ্লাস প্রভৃতি তৈজসপত্র দেখতে পাওয়া যেত কোনও কোনও বাড়িতে মশলা পেষায় করার শিলনোড়া আজও পাওয়া যায় দেখা মেলে শস্য পেষায়এর যাঁতাওএসবই প্রস্তর শিল্পীদের বিস্ময়।তাই একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হয়, সুপ্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রস্তর শিল্প এক শ্রেণীর মানুষের পেশাগত লোকায়ত শিল্প হয়ে রয়েছে
     যদিও কোনও কিছুই চিরস্থায়ী নয়। প্রস্তর শিল্পও স্বাভাবিকভাবে আজ অবলুপ্তির পথে। বর্তমান যুগে পাথরের পরিবর্ত দ্রব্য হিসাবে স্থান নিয়েছে সহজলভ্য প্লাস্টিক বা ধাতবীয় দ্রব্যকিন্তু এযুগেও গ্রামবাংলার এক শ্রেণীর প্রান্তিক মানুষ পুরনো দিনের সেই পাথর খোদাই করে আজও ভাত, কাপড় আর বাসস্থানের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। এমনই এক চিত্র দেখা গেল বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে।
2
     পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত পাহাড়ি অঞ্চল হিসাবে বেশ পরিচিত বাঁকুড়া জেলাযার রূপে মোহিত হতে চান যে কোন পর্যটক। প্রায় ১৪৫০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট বনভূমি ঘেরা শুশুনিয়া পাহাড় যে কারোরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যথেষ্ট
     অঞ্চলটি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ তা নয়, প্রস্তর শিল্পে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেবঙ্গদেশের সবচেয়ে প্রাচীন পাথর খোদাইয়ের কেন্দ্র শুশুনিয়ায় আছে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করেন। পাহাড়ের কোলে গন্ধেশ্বরী নদীর তীরে এখানকার শুশুনিয়া গ্রামটি আজও প্রস্তর যুগের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। শিল্পীদের অসাধারণ দক্ষতা, শিল্প নৈপূর্ণ্যতা ও পরিশ্রমে গড়ে উঠছে বিভিন্ন ধরনের পাথরের অসাধারণ শিল্পকর্ম। এক-একটি পাথরের শিল্পকর্মের উচ্চতা ২০-২৫ ফুটের মতো। আবার খুব ছোট উচ্চতার পাথরের শিল্পকর্ম রয়েছে।
     এখানকার প্রস্তর শিল্পের ধারাবাহিকতার প্রধান কারণ স্থানীয় কাঁচামালের সহজলভ্যতা। পাথুরে এই এলাকায় শিল্প-কর্মের উপযুক্ত পাথরের অভাব বিশেষ নেই বললেই চলে। তাই জীবন ধারণের অন্যতম সম্বল পাথর খোদাই করে দৃষ্টি নান্দনিক শিল্পকর্ম প্রস্তুত করার চল এখনও অব্যাহত। বৃহৎ আকারের পাথরের মূর্তি থেকে ক্ষুদ্রাকৃতি প্রদীপ সমস্ত কিছুই যেন নিখুঁতভাবে তৈরি করেন শিল্পীরা। বর্তমানে অলংকার হিসাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে এই পাথর। শিল্পীদের এই পাথরে তৈরি বিভিন্ন সূক্ষ্মতর কাজ সহজেই মনকে স্পর্শ করে
3
     পাথর খোদাইয়ের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে হাতুড়ি, বাটালি ও বিভিন্ন নাম না জানা সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি। মাঝে-মধ্যে কিছু বিশেষ পাথরের প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন উড়িষ্যা বা অন্ধপ্রদেশ থেকে পাথর আমদানি করতে হয়। এখানকার বেশ কিছু শিল্পী রাষ্ট্রপতি ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন। এসব কিছুই প্রমাণ করে শুশুনিয়ার প্রস্তর শিল্পের সমৃদ্ধি ও পরিপূর্নতা।
     কিন্তু সুপ্রাচীন এই পাথর শিল্প আজ প্রায় অন্ধকারের পথে। বর্তমান প্রজন্ম ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে এই শ্রমসাধ্য শিল্পকর্ম থেকে। এছাড়া এই শিল্পের প্রচারের সীমাবদ্ধতা, বিপনণের ব্যবস্থা অবলুপ্তি অন্যতম কারণ হিসাবে বলা যায়উৎপাদনে সময় ব্যয় হয় বেশি, কিন্তু সেই তুলনায় মূল্য পাওয়া যায় কম। আসল কথা উৎপাদক ও ক্রেতার মধ্যে যথেষ্ট যোগাযোগের অভাব প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে এই শিল্পের।
Advertisement
Previous article‘আমার কুটির’ ভাষা দিবসের অঙ্গীকার নিয়ে আয়োজন করল রক্তদান শিবিরের
Next articleপ্রায় শেষ হতে চলেছে লাভপুরের ফুল্লরা মেলা (ভিডিও সহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here