কারুশিল্পে ‘শান্তিনিকেতনী ঘরানা’র স্রষ্টা রথীন্দ্রনাথ ও শিল্পসদন

Advertisement
Rathin
অতনু কুমার সিংহ : রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৭ নভেম্বর ১৮৮৮৩ জুন ১৯৬১) ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এক ব্যক্তিত্বএকাধারে স্থপতি, চিত্রশিল্প, উদ্যানবিদ, সাহিত্যিক, সর্বোপরিরবি রথের সারথি ১৯০১ সালে পিতার তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র, বিশ্বভারতী পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়(১৯১৮) থেকে শ্রীনিকেতনের সক্রিয় কর্মী, বিশ্বভারতীর জন্মলগ্ন (১৯২১) থেকে কর্মসচিব এবং তারপর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় রূপে (১৯৫১৫৩) বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য আমেরিকার আরাবানা প্রদেশের ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিদ্যায় প্রশিক্ষিত রথীন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তিনিকেতন আশ্রমের একজন প্রধান কর্মী, তার কাজে প্রাধান্য পেয়েছিল আশ্রমে পিতার স্বপ্ন ও কল্পনার বাস্তব রূপদান, সামাজিক কর্তব্য বিশ্বভারতীর কাজ অথচ, পিতার জন্মশতবর্ষে বিশ্বভারতী সংসদের সদস্য, ‘বিশ্বভারতী সোসাইটির সম্পাদক, রবীন্দ্রভারতীর ডিরেক্টর রথীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রাত্য আমন্ত্রণও পাননি রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ বিষয়ে শান্তিনিকেতনে কোনও আলোচনায়
     জন্মেছিলেন সেকালের এক ঐতিহ্যশালী পরিবারেপ্রপিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর, পিতামহ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যাঠামশাই দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতো বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বের সারি; ছিলেন গগনদাদা (গগনেন্দ্রনাথ), অবনদাদা (অবনীন্দ্রনাথ), সমরদাদা(সমরেন্দ্রনাথ)পিতৃস্মৃতিগ্রন্থে রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘জন্মেছি শিল্পীর বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের, কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের মেনকা ঠাকুর তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘রথীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন চারুশিল্পী মন নিয়ে, কিন্তু হয়ে উঠেছিলেন কারুশিল্পী
     বিংশশতাব্দীর প্রারম্ভে শহরের কলকারখানার বাড়বাড়ন্তে গ্রামের শিল্পী সমাজ ভেঙে পড়লে শিল্পীকে মজুরে পরিণত করা হচ্ছে দেখে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন গ্রামের মানুষের উন্নতির সাথে সাথে তাঁদের শিল্পরুচিসম্মত করে তুলতে এবং এর জন্য কুটির শিল্পের উন্নতি ও বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধিও করেছিলেন গ্রামকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার যে স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন তা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে হাতেকলমে কারুশিল্পের কাজ বিশ্বভারতীতে প্রথম শুরু হয় আশ্রমেরদাদাবাবুরথীন্দ্রনাথ ও তাঁর স্ত্রী প্রতিমা দেবীর (সকলেরবৌঠান’) উদ্যোগে ১৯২২ সালে শান্তিনিকেতনে কলাভবন প্রাঙ্গণে, ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার এক বছর পরে এই কর্মকাণ্ডের সূচনা হয়েছিল ১৯১৫১৬ সালে, জোড়াসাঁকোয় রথীন্দ্রনাথসহ রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু অনুগামীদের তৈরিবিচিত্রা স্টুডিওর মাধ্যমে পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে পরিত্যক্ত একটি চালাঘরকে সংস্কার করে নাম দেওয়া হয়হল অফ্ ইন্ডাস্ট্রিজ্ এই শেডের তলায় শুরু হয় তাঁত, শতরঞ্জি, আসন, বস্ত্ররঞ্জন এবং ছাপাই, সূচিশিল্প, গালার কাজ, বই বাঁধানো পরবর্তীকালে যুক্ত হয় চামড়ার কাজ, বাটিক, কাঠের কাজ ও ধাতুশিল্প
Ra
     শান্তিনিকেতনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত আরও বড় জায়গার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ১৯২৮ সালে স্থানান্তরিত হয় শ্রীনিকেতনেকুঠিবাড়ির নিচে একটি ঘরে ১৯৩৭ সালে এই বিভাগটির নাম হয়শিল্পভবন পল্লিসংগঠনের কাজের সূত্রে কারুশিল্প ও চারুশিল্প পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে বিস্তার লাভ করলে নাম হয়ইন্ডাস্ট্রিজ ডিপার্টমেন্ট অফ্ শ্রীনিকেতন ১৯৫১ সালে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভের সময় নানা ঘাত, প্রতিঘাত, প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্বভারতীর পল্লিসংগঠন বিভাগের অন্তর্গত হয় ও নাম হয়শিল্পসদন
     রথীন্দ্রনাথের সুযোগ্য নেতৃত্বে গড়ে ওঠেশিল্পভবনএর মজবুত ভিত এবং মূলত তাঁরই উদ্যোগে এদেশে সর্বপ্রথম জাতিধর্ম ভেদাভেদের উপেক্ষা করে গ্রামে গ্রামে প্রশিক্ষিত কারুশিল্পী নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন শিল্পে হাতেকলমে কাজ শেখানোর চেষ্টা শুরু হয় ১৯২৮১৯৫১ সাল অবধি রথীন্দ্রনাথ ছিলেন এই বিভাগের কর্ণধার প্রকৃতপক্ষে রথীন্দ্রনাথের অক্লান্ত চেষ্টা ও পরিশ্রমে শিল্পভবনের মাধ্যমে ভারতবর্ষের কারুশিল্পের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় ধীরে ধীরে শিল্পভবন শ্রীনিকেতনের পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষের কাছে রুজিরোজগারের এক আকাঙ্ক্ষিত কর্মস্থল হয়ে ওঠে কাজকে আমরা যে বাটিক শিল্প, সৌন্দর্যমণ্ডিত চর্মশিল্প, বননশিল্প, আসবাবপত্র নির্মাণ, স্থানীয় মৃত্তিকা নির্মিত গ্লেজপটারি, নতুন নতুন ডিজাইনের হ্যান্ডলুম শাড়ি, বেডকভার, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, দরজাজানলার পর্দা, বাটিকের চাদর, পোড়ামাটির কাজ দেখি তার সূত্রপাত হয়েছিল শিল্পভবনের মাধ্যমে
     কারুশিল্পে দেশেবিদেশে খ্যাত ও চাহিদাযুক্তশান্তিনিকেতনী রীতিপ্রবর্তন করার মূলে ছিলেন রথীন্দ্রনাথ দেশবিদেশ থেকে কুটিরশিল্পের পদ্ধতি ও প্রকরণ এনে তিনি শান্তিনিকেতনে স্থান দিয়েছিলেন যবদ্বীপ থেকে বাটিকের কাজ, মিলান থেকে চামড়ার কাজ, গঠনশৈলীতে জাপানি রীতি শিখে এসে শান্তিনিকেতনে তার সফল প্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন ১৯৩৭ সালে শিল্পভবনের শিল্পদ্রব্যের চাহিদা মেটাতে কলকাতায় ২১০ কর্নওয়ালিস স্ট্রীটেশান্তিনিকেতন শিল্প ভাণ্ডারবিক্রয়কেন্দ্র খোলা হয় তৎকালীন জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বোস এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন শিল্পভাণ্ডারের উদ্বোধনী অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে রথীন্দ্রনাথ বলেন, ‘… আমাদের কর্মব্যবস্থায় আমরা জীবিকার সমস্যাকে উপেক্ষা করিনি, কিন্তু সৌন্দর্যের পথে আনন্দের মহার্ঘ্যতাকেও স্বীকার করছিঅর্থ না হলে একে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয় বলেই আমরা আশা করি এইসকল শিল্পকাজ আপন উৎকর্ষের দ্বারাই কেবল যে সম্মান পাবে তা নয়, আত্মরক্ষার সম্বল লাভ করবে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘… আমরা শ্রীনিকেতনে যা করতে চেয়েছি এরা সমস্ত দেশ জুড়ে প্রকৃষ্টভাবে তাই করছে (শ্রীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ; পল্লীপ্রকৃতি)
     গ্রাম সংগঠনের সাথে সাথে শিল্পসদন আজও চারুকারু কুটিরশিল্পেশান্তিনিকেতনী ঘরানার নিজস্বতা বজায় রেখে চলেছে ২ বছরের ডিপ্লোমা কোর্স, ৬ মাসের সার্টিফিকেট কোর্স বা ৪ মাসের স্নাতক কোর্সে এখানে বয়নশিল্প, তাঁত, দারুশিল্প, সূচীকর্ম ইত্যাদিতে অধ্যয়নের সুবিধা আছে শিল্পসদনের তত্ত্বাবধানে গ্রামীণ শিল্পীদের শিল্পের কাঁচামাল ও ডিজাইন ইত্যাদি সরবরাহ করা হয় ও প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় দুঃস্থ হস্তশিল্পীদের কাজ বিভিন্ন প্রদর্শনীতে নমুনা প্রদর্শনের মাধ্যমে, বিভিন্ন স্থানীয় মেলাতে (পৌষমেলা, শ্রীনিকেতন বার্ষিক উৎসব, রথীন্দ্রনাথমেলা ইত্যাদি) বিপণনের ব্যবস্থা গড়ে তুলে গ্রামবাসীর মধ্যে স্বনির্ভরতার আশা জাগিয়ে তোলা হয়, স্থানীয় কারুশিল্পীরাও উপকৃত হন বিক্রি থেকে ভালো রোজগার হতে থাকে
Advertisement
Previous articleছুটে আসছে পঙ্গপাল, কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা
Next articleমারা গেলেন ল্যারি, রয়ে গেল তাঁর কপি-কাট-পেস্ট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here