Advertisement
সুপ্রভাত দত্ত : চিত্রকর ও চিত্রশিল্পী এই দু’টি আমাদের কাছে অতি পরিচিত শব্দ। কিন্তু এই দু’টি শব্দকে একই অর্থের ঘেরাটোপে বেঁধে অনেকে ভুল করেন। বিস্তর ফারাক আছে এই দুই শব্দের মধ্যে।
ছবিকে হুবহু ছবির মতো এঁকে ফুটিয়ে তোলা হল চিত্রকরের প্রধান কাজ। এখানে কোনও কল্পনার স্থান নেই। আর চিত্রশিল্পী অনুসন্ধান করেন ছবির ভিতর ভাব, রূপ, রস ছন্দ। অতি সাধারণ ছবিও অসাধারণত্বের রূপ পেয়ে থাকে শিল্পীর মনন ও তুলিতে।
ইতিহাস চিত্রশিল্পের ব্যাপারে গভীর আলোকপাত করেছে দু’টো যুগ বা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। প্রথমটি ঘটেছিল ১৩০০ থেকে ১৬০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে। যাকে আমরা রেনেসাঁস বলি। দ্বিতীয়টি এখনও চলছে। যার সূত্রপাত হয়েছিল আনুমানিক ১৮৬০ খৃষ্টাব্দের পর থেকে। এই দ্বিতীয়টি হল ‘ইম্প্রেশানিজম’ আন্দোলন।
নিউক্লাসিক্যাল যুগের ধ্রুপদী শিল্প রোম্যান্টিক আবেগের ঘন অনুভূতি এবং রিয়েলিজমের নিরেট বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে উনবিংশ শতাব্দীতে এটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই ইম্প্রেশানিজমের জন্ম এমন একটি সময় হয়েছিল, যখন মানুষ ‘পেইন্টিং’ মানে বুঝত ধর্মগ্রন্থের কাহিনি বা সামনাসামনি প্রকৃতি অঙ্কন। ল্যান্ডস্কেপ ও Still Life (স্থির চিত্র)-কে অতি নিম্ন মানের ভাবা হত।
তৎকালীন তরুণ শিল্পী ক্লোদ মোনে, রেনোয়ার, অ্যালফ্রেড সিসলি ও ফ্রেডরিখ বেথিল এই চার বন্ধু ছবিতে ব্রাশস্ট্রোক ও রঙের ভিন্নতাকে নতুনভাবে প্রয়োগ ঘটালেন এই আন্দোলনে। পরে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন পল সে জান, রেমব্রন্ট প্রমুখ শিল্পীরা।
ইম্প্রেশানিস্ট শিল্পীরা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন কোনও বস্তুর ছায়া মানে ‘কালো’ বা ‘ছাই’ রঙ নয়, প্রতিটি বস্তুর ছায়া ভিন্ন ভিন্ন রঙের হয়। বিশেষত যে স্থানের ওপর কোনও বস্তুর ছায়া পড়ে সেই স্থানটি যে রঙের হয় তার থেকে একটু গাঢ় হবে সেই বস্তুর ছায়ার রঙ। এই সব শিল্পীরা দ্রুততার সঙ্গে চিত্ররচনায় তুলির বলিষ্ঠ টান এড়িয়ে স্প্যাচুলা দিয়ে ভারি রঙ প্রয়োগের মাধ্যমে ছবির ভাব প্রকাশের চেষ্টা করত। ফলে শিল্প–কর্ম দেখে মনে হত তেল রঙের স্কেচ। রঙ প্রয়োগে ‘অপটিক্যাল মিক্সিং’ পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ চিত্রে বেগুনি রঙ প্রয়োজন। কিন্তু এখানে সরাসরি লাল ও নীল রঙ–কে না মিশিয়ে তাদেরকে ক্যানভাসে পৃথকভাবে পাশাপাশি প্রয়োগ করে বেগুনি আভাটি আনত। এই শিল্পীরা রঙ ও আলোকেই প্রধান উপজীব্য করেছিলেন।
ইম্প্রেশানিস্টরা ভাবতেন রঙ–ই আলো, বর্ণের আদি উৎস হল সূর্য। তাই রঙ–এ জল বা তেল না মিশিয়ে সরাসরি টিউব থেকে ক্যানভাসে প্রয়োগ করতেন। এই আন্দোলনের সঙ্গে ‘হাইলাইট’ শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যা ভীষণভাবে পরিলক্ষিত হয় শিল্পী রেমব্রান্ট–এর ছবিতে। আলোর প্রতিফলনের নির্ভুল প্রয়োগ ও সাদা রঙ–এর সঠিক ব্যবহার কোনও বস্তুর মধ্যে হাইলাইট সৃষ্টি করতে পারে।
তবে অনেকে এই পদ্ধতি পছন্দ করলেন না। সেই সময় পৌরাণিক কাহিনি, ধর্মগ্রন্থ নিয়ে ব্যাপক ছবি আঁকা হত। তাঁরা বললেন, ‘এখানে জেসাসের কোনও ছবি নেই, যুদ্ধেরও কোনও প্রেক্ষাপট নেই। আছে শুধু ক্ষেত মজুর, আপন প্রেমিকা, জলের প্রবাহের ছবি।’ ফলে তাঁরা অকাদেমিতে ছবি প্রদর্শন বন্ধ করলেন। পরে এই শিল্পীরা প্যারিসে ‘Salon Des Fefuses’ নামে প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন স্বয়ং তৃতীয় নেপোলিয়ন। আবার শুরু হল সমালোচকদের কট্টর সমালোচনা। তারা এই সব কাজ দেখে বিদ্রুপ করে বলতেন, ‘ইম্প্রেশানিজম’। আর সেই নামকে শিল্পীরা পজিটিভভাবে গ্রহণ করে শিল্পের ইতিহাসে ঘটালেন যুগান্তকারী আন্দোলন।
![]() |
ক্লোদ অসকার মোনে |
ক্লোদ মোনে ছিলেন ইম্প্রেশানিজম আন্দোলনের প্রধান শিল্পী। পুরো নাম ক্লোদ অসকার মোনে। জন্ম ১৮৪০ খৃষ্টাব্দে ছবির দেশ প্যারিসে। তাঁর পিতা ছিলেন মুদির দোকানদার। পড়াশোনায় একেবারেই মনোযোগী ছিলেন না তিনি। শুধু ছবি এঁকেই খাতা ভরাতেন। বন্ধু বুঁদ্যার উৎসাহে শুরু হল প্রকৃতির কোলে ল্যান্ডস্কেপ আঁকা। নর্মান্ডির উপকূলবর্তী অঞ্চলটি ক্লোদ মোনের আঁকার প্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছিল।
কোনও একদিন এই উপকূলে বসে ছবি আঁকছিলেন শিল্পী। এমন সময় ঝড় উঠল। এরকম অবস্থায় তল্পিতল্পা গুটিয়ে কেটে পড়াটায় ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু না! তিনি গেলেন না। অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলেন ঝোড়ো হাওয়ায় ফুলে ফেঁপে ওঠা সামনের সমুদ্রকে। ঢেউয়ের মাথায় সূর্যের ঝিলিক, আলোর বাড়া–কমা, রঙ–এর সহসা পরিবর্তন। কিন্তু এত দ্রুত ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলি এক সঙ্গে ক্যানভাস বন্দি করতে পারছিলেন না শিল্পী। তাই তিনি রঙের এক একটি আভাকে আলাদা আলাদা ক্যানভাসে আঁকতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে তাঁর পরনের কাপড় ভিজে উঠেছে। তবুও তিনি এঁকেই চলেছেন। – এই ছিল ক্লোদ মোনে।
তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত ছবি উল্লেখ করা যায় ‘বাগানের মহিলারা’, ‘ইম্প্রেশন: সূর্যোদয়’। ছবির সিরিজ ‘খড়ের গাদা’ (১৫টি ছবি)। এগুলির মধ্যে তাঁর এক বিখ্যাত চিত্রটি হল ‘পদ্ম পুকুর’। এই চিত্রে শিল্পী পুকুর জলের উপরি স্তরের সঙ্গে জলের গভীরের আলোকে তুলে এনেছেন। এ এক অসাধারণ আলো–ছায়ার ইম্প্রেশন। সাদা পদ্ম সবুজ পাতা এবং পুকুরপাড়ের ঝোপ–জঙ্গল আর গাছপালার ছায়া। জলের মধ্যে ময়ূরকণ্ঠী রঙ ধারণে সহায়তা করেছে। পদ্ম কখনও গোলাপি, কমলাটে আর হলুদ বর্ণে সেজেছে। কোথাও কোথাও আবার রঙ জলের ওপরেও খেলা করছে। ঝিলমিল রঙ–এ চঞ্চল পদ্ম ভেসে বেড়াচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলের নীল জলে কালচে সবুজ পাতার বেষ্টনীতে উঁকি দিচ্ছে।
ইম্প্রেশানিস্টরা সাধারণত স্টুডিওর চাইতে খোলা আকাশের নিচে ছবি আঁকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এটাই তাঁদের ছবির মধ্যে রিয়ালিস্টিকের প্রধান কারণ।
Advertisement