Advertisement
সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : স্বর্ণলতা নামক বাহারি পরজীবী গাছটিকে গ্রাম–বাংলায় আমরা আসা-যাওয়ার পথের ধারে অনেকেই দেখেছি। এই গাছটি মূলত গ্রীষ্মপ্রধান দেশেই বেশি দেখতে পাওয়া যায়। শীতপ্রধান অঞ্চলে মাত্র চারটি প্রজাতি দেখতে পাওয়া যায়। অনেকে এটিকে উজ্জ্বল সোনালী আভার জন্য আলোকলতা বলে থাকেন। সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় আকাশবল্লি, কোথাও কোথাও এটিকে অমর বেল বা আকাশ বেলিও বলে। তবে বিদেশে এর ক্ষতিকারক প্রভাবের জন্য গাছটিকে পেত্নী লতা, শয়তানের চুল বলে অভিহিত করা হয়। এই লতা গাছকে খুব জোরে পেঁচিয়ে ধরে বলে ইংরেজ সুরসিকরা স্বর্ণলতাকে Love Vine বলেও ডেকে থাকেন। স্বর্ণলতার ইংরেজি নাম Giant Dodder, বৈজ্ঞানিক নাম Cuscuta Reflexa। সারা পৃথিবীতে এর প্রায় ১৭০টি প্রজাতি রয়েছে।
এই গাছ প্রধানত বর্ষজীবী। হেমন্তের শেষ থেকে এই গাছের বৃদ্ধি শুরু হয়। বসন্ত ঋতুতে এই গাছ মোহিনী রূপ ধারণ করে। গাছটি মূলত সরু সরু সোনালীর লতার জটাজাল বিস্তার করে আশ্রয়দানকারী গাছটিকে পুরোপুরি আচ্ছাদিত করে ফেলে। এই গাছের কোনও পাতা থাকে না, শুধুই সুতোর মতো তন্তুজাল। তবে কোনও কোনও প্রজাতির মধ্যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আঁশের মতো পাতা দেখতে পাওয়া যায়। বসন্তকালে ছোটো ছোটো সাদা ফুল ফোটে এবং ফল ধরে। ফল পাকে গ্রীষ্মের সময়।
স্বর্ণলতা বীজ থেকে বংশবিস্তার করে। বীজ মাটিতে পড়ে গাছ জন্মানোর পর এর লতাগুলি আশ্রয়দানকারী উপযুক্ত গাছের অনুসন্ধান চালাতে থাকে – এ বিষয়ে গাছটির অদ্ভুত ক্ষমতা লক্ষ্য করা যায়। তবে পাঁচ থেকে দশ দিনের মধ্যে উপযুক্ত আশ্রয়দানকারী গাছ অবলম্বন করতে না পারলে লতাগুলি মরে যায়। কারণ এই পরজীবী গাছে কোন ক্লোরোফিল না থাকায় এই গাছ সালোকসংশ্লেষ–এর মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করতে পারে না। খাদ্য সংগ্রহের জন্য স্বর্ণলতা পুরোপুরি আশ্রয়দানকারী গাছটির উপর নির্ভর করে। স্বর্ণলতা তার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শোষক মূলকে যাকে হস্টোরিয়া(Hosteria) বলা হয়, তার সাহায্যে গাছের জাইলেম–ফ্লোয়েমের ভেতর থেকে প্রাণরস ও জল শোষণ করে বেঁচে থাকে। সম্প্রতি পেন্সিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন এক আশ্চর্য জনক তথ্য। পরজীবী স্বর্ণলতার হস্টোরিয়া আশ্রয়দানকারী গাছের জিনও চুরি করে নেয়। সেই জিনগুলির সাহায্যে এমন অনু তৈরি করে যার ফলে হস্টোরিয়াগুলি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং খুব সহজে অনেক বেশি করে খাদ্য রস ও জল শোষণ করতে সক্ষম হয়। জিনগত মিলের জন্য আশ্রয়দানকারী গাছটিও বুঝতে সক্ষম হয় না তার খাদ্যরসে ভাগ বসাচ্ছে পরজীবী উদ্ভিদ। ঘটনাটি ‘নেচার প্লান্ট’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। যাইহোক, ক্রমাগত খাদ্যরস ও জল শোষণ করার ফলে আশ্রয়দানকারী গাছটির মৃত্যু হওয়া খুবই সম্ভব।
আমাদের দেশে আম, কুল, পলাশ, শিরীষ, আমলকি, বেল, কাঁঠাল, নিম সহ বিভিন্ন ফসলের গাছকে এরা আক্রমণ করে। যদিও স্বর্ণলতার প্রথম পছন্দ হল কুল, বাবলা জাতীয় গাছ। এই গাছগুলিতে কাঁটা থাকে বলে এগুলি থেকে সহজে লতাগুলো ছিড়ে আলাদা করা যায় না। তবে যে কোনও ফলের গাছকেই সে আশ্রয় করে। যে গাছটিতে আশ্রয় নেয় সেই গাছের ফলন কমা থেকে শুরু করে গাছটির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। স্বর্ণলতা একবার যে গাছে আশ্রয় নেয়, সেই গাছে প্রতিবছরই জটাজাল বিস্তার করে গাছটির বৃদ্ধি ব্যাহত করে। শুধু তাই নয় একটি আক্রান্ত গাছ থেকে পাশাপাশি অন্য সুস্থ গাছগুলিও আক্রান্ত হয়।
স্বর্ণলতা যে শুধুমাত্র বড় গাছকেই আক্রমণ করে তা নয়, আলু, টমেটোর মতো ফসলের গাছকেও আক্রমণ করে থাকে। তাই এই গাছের আক্রমণ থেকে ফলের গাছ ও ফসল বাঁচানোর অন্যতম উপায় হল ফল আসার আগেই এই গাছকে শোষক মূল (Hosteria) সহ উৎপাটন করা। এছাড়া বীজ থেকে লতা বের হওয়ার পাঁচ থেকে দশদিনের মধ্যেই লতাগুলিকে তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। কারণ বীজের মধ্যে লতাগুলির বেঁচে থাকার মতো রসদ জমা থাকে মাত্র দশ দিনের মতো। কাজেই দশ দিনের মধ্যে স্বর্ণলতা যদি আশ্রয়দানকারী গাছ খুঁজে নিতে না পারে তাহলে লতাগুলি আপনা থেকেই মারা পড়ে। কারণ এই ধরনের পরজীবী গাছ কোনও অবস্থাতেই নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে না। অন্য গাছের আশ্রয় তাদের নিতেই হয়। তাই বাহারি দেখতে হলেও ক্ষতিকারক গাছ হিসেবে এই গাছকে কৃষকরা একদম পছন্দ করেন না।
ভারতীয় আয়ুর্বেদ ও চৈনিক ভেষজ শাস্ত্রে এই গাছকে বায়ু পিত্ত ও কফ নাশক বলা হয়েছে। খোস পাঁচড়া কৃমি, জন্ডিস, রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, লিভারের রোগ এমনকি ক্যান্সারের ওষুধ হিসেবেও এই গাছটি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে এর সত্যতা কতটা তা এখনও প্রমাণিত হয়নি।
‘জীবনের কবি জীবনানন্দ’ লিখেছেন, “সেখানে মানুষ কেউ যায় নাকো দেখা যায় বাঘিনীর ডোরা / বেতের বনের ফাঁকে জারুল গাছের তলে রৌদ্র পোহায় / রূপসী মৃগীর মুখ দেখা যায় – সাদা ভাঁট পুষ্পের তোড়া / আলোক লতার পাশে গন্ধ ঢালে দ্রোণ ফুল বাসকের গায়।”কবি যতই লিখুন না কেন, এই গাছটির মোহিনী মায়া থেকে দূরে থাকাই ভালো। কারণ এই গাছটি নানা ধরনের ক্ষতিকারক ভাইরাস ও পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল। তাই এই গাছের সংস্পর্শে এলে এলার্জি থেকে নানা ধরনের শারীরিক সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। অতএব সাধু সাবধান।
Advertisement