Advertisement
ধ্রুব পাল : ইতিহাসের পাতায়অসংখ্য সুন্দরী মহিলার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু তাদের মধ্যে এমন কিছু সুন্দরী মায়াবী নারীছিল যারা নিজের রূপ ও যৌবন ধরে রাখতে জঘন্য থেকে জঘন্যতম কাজগুলি করতেও কুণ্ঠিত হত না। এরকমই একজন ছিল এলিজাবেথ বাথোরি। যে নিজের অপূর্ব মায়াবী রূপ আর যৌবন আজীবন ধরে রাখতে নিজের দেশেরই শত শত সুন্দরী কুমারী মেয়েকে হত্যা করে তাদের তাজা ও উষ্ণরক্তে স্নান করত।
এলিজাবেথ বাথোরিকে পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জানা যায়, সে প্রায় ৬৫০ জন কুমারী মেয়েকে হত্যা করে তাদের রক্তে স্নান করেছে। গ্রামবাসীরা এলিজাবেথের ভয়ে তাদের কন্যাসন্তানদের লুকিয়ে রাখত। তার ভয়ঙ্কর সব কর্মকান্ডের জন্যই ইতিহাস তার নাম দিয়েছে দ্য ব্লাড কাউন্টেস।
হাঙ্গেরির এক ক্ষমতাশালী প্রটেস্টাইন পরিবারে ১৫৬০ সালে এলিজাবেথ জন্মগ্রহণ করে। তার বাবা ছিল ব্যারন জর্জ বাথোরি এবং মা ছিল ব্যারোনেস আ্যনা বাথোরি। এলিজাবেথের বেড়ে ওঠার পরিবেশ একদমই স্বাভাবিক ছিল না। কুসংস্কার আর গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন ছিল তাদের পরিবার। তুচ্ছ কারণগুলিতেও কর্মচারীদের ভয়ঙ্কর কঠিন শাস্তি দেওয়া হত। জিপসিদের উপর চালানো হত অকথ্য অত্যাচার। তাদের পরিবার জিপসিদের একেবারেই পছন্দ করত না। এলিজাবেথের পিসি ছিল একজন স্যাডোম্যাসোকিস্ট এবং কাকা ছিল শয়তানের পূজারি। ধারণা করা হয়, এই কাকার কাছ থেকেই স্যাটানিজমের অনুপ্রেরণা পেয়েছিল এলিজাবেথ।
এই রকমই এক কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অমানবিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে এলিজাবেথও পরিণত হতে শুরু করেছিল এক জটিল মানসিক রোগীতে। ঘনঘন মৃগীরোগ অর্থাৎ সিজার আ্যটাক হতে থাকে, হঠাৎ হঠাৎ ঘোরের মধ্যে চলে যেত এলিজাবেথ। এভাবেই চলতে থাকে দিনের পর দিন। যখন এলিজাবেথ পা দেয় পনেরো বছর বয়সে, তখনই তাকে পারিবারিকভাবে বিয়ে দেওয়া হয় কাউন্ট ফেরেন্স নাদাসদির সঙ্গে। ফেরেন্স ছিল হাঙ্গেরির সেনা প্রধান, যে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধতে অসামান্য বীরত্ব দেখিয়েছিল।
ফেরেন্স যে একজন অসাধারণ বীর ছিল, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। তবে তার বীরত্বের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠেছিল নিষ্ঠুরতা। স্বামীর সাথে থাকতে থাকতে এলিজাবেথ দেখতে পেল অত্যাচারের আরও নতুন নতুন পন্থা। তবে এলিজাবেথ ততদিনে ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছে বেশ।
১৬০৪ সালের এক যুদ্ধে গুরুতরভাবে আহত হয় কাউন্ট ফেরেন্স নাদাসদি। পরে ৪৮ বছর বয়সে সে মারা যায়। রাজ্যের সমস্ত দায়িত্ব এসে পরে এলিজাবেথের ওপর। এলিজাবেথের তিন কন্যা এবং এক পুত্র তখনও প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি।
এই সময় থেকেই এলিজাবেথ নৃশংস হতে শুরু করে। তবে এ নিয়ে অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। এক সকালে এলিজাবেথের চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল এক কুমারী সেবিকা। অসাবধানতাবশত হঠাৎ চুলের গোছায় একটু জোরে টান পরে যায়। এলিজাবেথ এতে প্রচন্ড রেগে বসে থাকা অবস্থাতেই হাতের পিছনের অংশ দিয়ে সেবিকার মুখে আঘাত করে। আঘাত এতটাই জোরালোছিল যে সেবিকার নাক ফেটে রক্ত এলিজাবেথের হাতে লেগে যায়। আর তখনই রাজ্যের কিছু জরুরি কাজ এসে পরাতে হাতের রক্ত মুছতে ভুলে যায় সে। ব্যস্ত হয়ে পরে কাজে। পরে যখন সে হাতে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত ধুয়ে ফেলে, দেখে তার চামড়া হয়ে গিয়েছে আগের চাইতে মসৃণ আর প্রাণবন্ত, ঠিক যেমনটি ছিল যৌবনকালে। সে তখন ভাবল, যদি কুমারী মেয়ের রক্তে স্নান করা যায়, তিনি নিশ্চয়ই লাভ করবেন চিরযৌবন! আর এভাবেই সূচনা হল এক ভয়ংকর ইতিহাসের।
স্বামীর মৃত্যুর পর নর্থওয়েস্ট হাঙ্গেরির (বর্তমানে স্লোভাকিয়া) ক্যাশতেকি দুর্গে বসবাস করতে চলে আসে এলিজাবেথ। এই দুর্গটি সে তার স্বামীর কাছ থেকে বিয়ের উপহার হিসাবে পেয়েছিল। এলিজাবেথ দুর্গে আসার পরেই আশেপাশের গ্রামের কুমারী মেয়েরা নিঁখোজ হতে শুরু করে। প্রথমদিকে অনেক কুমারী মেয়েই দুর্গে দাসী হিসাবে নিযুক্ত হত। প্রথমে তারা ভালোই বেতন পেত, পোশাক পেত। তাই সকলেই খুশি ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে তারা নিঁখোজ হতে শুরু করে। যেসব মেয়েরা কাজ করতে দুর্গে যেত তারা আর কখনও ফিরে আসত না। তাদের বাবা মায়েরা খোঁজ নিতে গেলে তাদের ভাগ্যে জুটতচরম অত্যাচার। গ্রামবাসীরা দুর্গের এক বয়স্কা সেবিকার কাছ থেকে জানতে পারে যে এলিজাবেথ কুমারী মেয়েদের রক্তে স্নান করে। এতে আতঙ্কিত হয়ে সাধারণ মানুষেরা তাদের কুমারী মেয়েদের দূর আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দিত বা গোপনে তাদের বিয়ে দিয়ে দিত। নাহলে যে তারা ব্লাড কাউন্টেস-এর হাতে প্রাণ হারাবে।
ধীরে ধীরে দুঃস্থ কুমারী মেয়েদের সংখ্যা কমে যেতে লাগল। এবার এলিজাবেথ বড় ঘরের মেয়েদের দিকে নজর দিল। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে এনে হত্যাও করল। কিন্তু বড় ঘরের মেয়েদের নিঁখোজ হওয়ার ঘটনায় টনক নড়ল প্রশাসনের। হাঙ্গেরির রাজা দ্বিতীয় মাথায়াসের কানে এই সংবাদ পৌঁছল। তিনি জানতে পারলেন, বহু কুমারী নারী এলিজাবেথের দুর্গে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। কিন্তু এলিজাবেথের বিরুদ্ধে সরাসরি এমন অভিযোগ তোলা সম্ভবও ছিল না। তখন এলিজাবেথের নিকট আত্মীয়েরাই ছিল হাঙ্গেরির সমস্ত প্রশাসনিক কাজের হর্তাকর্তা। কিন্তু রাজার পক্ষেও এই গুরুতর অভিযোগ শোনার পর চুপ করে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। রাজা নিযুক্ত করলেন কাউন্ট জুরাজ তুরযোকে। তুরযোকে বলা হল এলিজাবেথের বিরুদ্ধে সাক্ষী জোগাড় করতে।
জুরাজ প্রথমে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ঘটনা জানতে চাইল। তারা সকলেই জুরাজকে ত্রাণকর্তা ভেবে সমস্ত অভিযোগ তুলে ধরল। এমনকি দুর্গের কিছু কর্মচারি আদালতে সাক্ষী দেবে বলেও জানাল। সাক্ষী জোগাড় করে জুরাজ ক্যাশতেকি দুর্গে গেল এলিজাবেথকে গ্রেফতার করতে। সে যখন দুর্গে প্রবেশ করল, পরিচারিকাদের কাছ থেকে জানতে পারল এলিজাবেথ তার টর্চার রুমে রয়েছে। জুরাজ তুরযো তৎক্ষণাৎ এলিজাবেথকে হাতেনাতে গ্রেফতার করল এবং বেরিয়ে এল এক নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনা।
সাক্ষীদের কাছ থেকে জানা যায়, এলিজাবেথ তপ্ত লোহার শিক দিয়ে ভিক্টিমদের ছ্যাঁকা দিত, লোহার শিক দিয়ে পেটাত, তাদের নখের তলায় সূঁচ ঢুকিয়ে দিত। ভিক্টিমরা যখন প্রায় মৃত, তখন তাদের গলা কেটে তাদের সমস্ত রক্ত বের করে বাথটাব পরিপূর্ণ করত। তারপর সেই রক্তে স্নান করত এলিজাবেথ। শুধু তাই নয়, অনেক ভিক্টিমের ঘাড়ের রগ সে কামড়ে ছিঁড়ে রক্ত পান করত, ঠিক ভ্যাম্পায়ারদের মতো।সাক্ষীদের মতে, সে নিজেকে শয়তানের কাছে উৎসর্গ করেছিল এবং পরিণত হয়েছিল অভিশপ্ত এক ভ্যাম্পায়ারে।
জুরাজ তুরজো এলিজাবেথের বিরুদ্ধে ৮০ জন কুমারী মেয়ে হত্যার অভিযোগ আনল, যাপরে আদালতে প্রমাণও হয়। এলিজাবেথকেঅবশ্য মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়নি। তাকে ক্যাশতেকি দুর্গের একটি কক্ষে গৃহবন্দি করে রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই ঘরে বাইরে থেকে আলো–বাতাস ঢোকার কোন ব্যবস্থা ছিল না। শুধুমাত্র একটি ছিদ্র দিয়ে বাইরে থেকে একবেলা খাবার পাঠানো হত। সেখানেই সে চার বছর বন্দী ছিল এবং ১৬১৪ সালে মারা যায়।
একজন সাক্ষী বলেছিল, এলিজাবেথ একটি ডায়েরীতে তার সমস্ত ভিক্টিমদের নাম এবং হত্যার দিন ও তারিখ লিখে রাখত। সেই ডায়েরীতে রয়েছে ৬৫০ জন ভিক্টিমের নাম। কিন্তু বহু অনুসন্ধানের পরেও সেই ডায়েরী খুঁজেপাওয়া যায়নি।
Advertisement