Advertisement
চিরন্তন দাস : প্রায় সারা বছরই জায়গাটা নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউই তেমন আসেন না। হাজার হাজার বাদুড়ের সমাবেশ ঘটে এখানে। তাও নীরবে। নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অতি প্রাচীন এক বটের ডালে তাঁদের তিনবেলা দুলতে দেখা যায়। কিন্তু মাঘের শেষ রবিবারটা যেন একটু অন্যরকমভাবে কাটে। হাজার হাজার মানুষের উল্লাসে যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে এই যাত্রাসিদ্ধি তলা। নামযজ্ঞ আর মহোৎসবে কেটে যায় সমস্ত দিন।
জায়গাটি পাঁচশোয়া-ছোটো শিমুলিয়া-দুর্গাপুর গ্রামের ঠিক মাঝখানে। বোলপুর থেকে বেশি দূরে নয়। বাহিরী যাওয়ার পথে নিমতলা মোড় পড়ে। সেখান থেকে ডান দিকে ঘুরে যেতে হয় ইঁটে তলার মোড়ে। তারপর কানা নদী। যা আবার অজয় নদের একটি সরু শাখা। এই নদী পার হয়ে যেতে হয় যাত্রাসিদ্ধি তলায়। সেকালে নদীর উপর কোনও সেতু বা ব্রিজ ছিল না। আর পায়ে হাঁটার পথটাও ছিল কাঁচা। পরে সত্তরের দশকে বিপ্লবী পান্নালাল দাশগুপ্ত মহাশয়ের সহযোগিতায় একটি কংক্রিটের সেতু তৈরি হয় এই কানা নদীর উপর। তারও পরে পিচের রাস্তা তৈরি হয়। এই পথ ধরেই এখন ভক্তদের নিত্য যাওয়া-আসা বাবার থানে।
থান সংলগ্ন স্থানটি বড়ো বড়ো বট-পাকুড় আর ঝোপঝাড়ে ভরা। তবে আশ্চর্য ক্ষমতা আছে শোনা যায়। এই থানে মানত করলেই নাকি ফল পাওয়া যায় হাতেনাতে। নিজের ইচ্ছামতো প্রতি রবিবার নৈবেদ্য সাজিয়ে নিজের পুজো নিজে দিয়ে সমস্যার কথা জানালেই হয়। এর জন্যে কোনও পুরোহিতেরও প্রয়োজন পড়ে না। তবে বর্তমানে পুরোহিত দ্বারা পূজিত হন যাত্রাসিদ্ধি বাবা।
স্থানীয়রা বলেন এর ইতিহাস নাকি হাজার বছরের পুরনো। কথিত আছে, অতীতে এক বুড়ো বাবা এখানে বাস করতেন। তিনি ঘণ্টা লাগানো ঘোড়ায় চড়ে প্রায়ই নিকটবর্তী গোঁসাইডাঙার শিব মন্দিরে বেড়াতে যেতেন। সেখান থেকে ডাঙাপাড়ার নারায়ণতলা হয়ে আবার ফিরে আসতেন থানে।আসলে ইনি-ই ছিলেন যাত্রাসিদ্ধি বাবা বা বুড়ো বাবা। আবার ধরমরাজও তাঁকেই বলা হতো।
পাশের গ্রাম পাঁচশোয়ার ধরমতলার বটগাছের নিচেও নাকি তাঁকে ঘুরতে দেখা যেতো। সে কথা স্মরণ করে আজও বৈশাখের পূর্ণিমা তিথির দুদিন আগে যাত্রাসিদ্ধি তলা থেকে বুড়ো বাবার অবয়বকে নিয়ে যাওয়া হয় পাঁচশোয়ার ধরমতলায়। তারপর গোটা গ্রাম পরিভ্রমণ করানোর পর পুজো দেওয়া হয়। পুজো উপলক্ষে বিপুল মানুষের সমাবেশে মেলা বসে। বলি দেওয়ার প্রথাও আছে। প্রতি বছর প্রায় দেড়শো পাঁঠা ও হাঁস বলি হয় এখানে।
যাত্রাসিদ্ধি তলার মহোৎসব কিভাবে শুরু হল সেই ঘটনাটিও অনেকটা অলৌকিক গল্পের মতো। ঘটনাটা একুশ বছর আগের। ছোটো শিমুলিয়ার বাসিন্দা লালমোহন দাসের অনেক দিনের ইচ্ছা হরিনাম ও মহোৎসব করার। কিন্তু দারিদ্রতার বাঁধা অতিক্রম করে কিছুতেই তা পেরে উঠছেন না। এরই মাঝে একদিন তিনি স্বপ্ন দেখেন, যাত্রাসিদ্ধি তলায় গ্রামের কিছু মানুষকে সাথে নিয়ে যাগযজ্ঞ সহ মহোৎসব করছেন তিনি। আর সেখানে উপস্থিত আছেন সয়ং বুড়ো বাবা।
পরে ওই গ্রামেরই বাসিন্দা নকুল চন্দ্র দাসকে তিনি ঘটনাটি খুলে বলেন। আর সেই সাথে যাত্রাসিদ্ধি তলায় মহোৎসব করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন। নকুল বাবু তাঁকে পাঁচশোয়ার শান্তি দেবাংশীর সাথে কথা বলতে বলেন। যিনি ধরমরাজ পুজোর দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন তখন। শান্তি বাবু শুনে পুরোহিতদের সাথে আলোচনা করতে বললেন। কিন্তু পুরোহিতরা আপত্তি জানায়। পরে দেবু দেবাংশীর (দাপা) কানে সে কথা পৌঁছালে, মহোৎসব করার পূর্ণ সমর্থন জানান তিনি। সেই সাথে যোগ দেন সুদর্শন মেটে, আদিনাথ চৌধুরী সহ আরও অনেকে।
প্রথম বছর লালমোহন বাবু ভিক্ষায় কিছু চাল-ডাল সংগ্রহ করে পঞ্চাশ জন মানুষকে সাথে নিয়ে মহোৎসব করেন। পরের বছর আবার তিনি মাঘের শেষ রবিবারে মহোৎসবের আয়োজন করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন। দুই কড়া খিচুড়ি রান্নার পর দেখা যায় মানুষ বেড়ে হয়েছে প্রচুর। কিন্তু অলৌকিকভাবে উদ্ধার পান তিনি। সারা আকাশ কালো করে হঠাৎ নেমে আসে বৃষ্টি। সবাই আর খিচুড়ি ভোগের অপেক্ষায় না থেকে সেখান থেকে সরে পড়েন।
পরের দুই বছর মহোৎসব বন্ধ ছিল। তারপর আবার শ্রীমৎ বেঙ্গলী মহারাজ ও নকুল দাসের তত্ত্বাবধানে নতুন কমিটি গঠিত হয়। কমিটিতে ছিলেন, লালমোহন দাস, নকুল চন্দ্র দাস, সুবল চৌধুরী, আদ্যনাথ চৌধুরী (মানা), সুদর্শন মেটে, প্রদীপ চৌধুরী, হিরণ্ময় মণ্ডল, দেবু দেবাংশী, দিলিপ আদক সহ আরও অনেকে। সেই শুরু। যা আজও সচল।
তাঁদের অনেকেই আজ বেঁচে না থাকলেও তাঁদের দেখানো পথে আজও প্রতি বছর হয়ে চলেছে যাত্রাসিদ্ধি তলার এই মহোৎসব।বর্তমানে প্রায় কুড়ি হাজার ভক্তের সমাবেশ ঘটে এখানে। ২০১৯ অর্থাৎ চলতি বছরে পাঁচশোয়ার উৎপল চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় পাঁচ লক্ষ টাকার চাতাল নির্মিত হয়েছে। বর্তমানে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
Advertisement