Advertisement
দেবকুমার দত্ত : বিশ্ববন্দিত জ্ঞানতাপস সক্রেটিস। প্রাচীন গ্রীসের এথেন্স নগররাষ্ট্রের বাসিন্দা। জীবদ্দশাতেই তিনি কিংবদন্তী। অথচ বাউণ্ডুলে, আড্ডাবাজ, অকম্মার ঢেঁকি। প্রচলিত ধর্মমতে ও অযৌক্তিক আচার-সংস্কারে অবিশ্বাসী। তাঁর জীবনবেদ- নিজেকে জানো; সত্যানসন্ধান থেকে বিরত হবে না। সত্যের জন্য মানবজাতির ইতিহাসে আত্মবলিপ্রদক প্রথম শহীদ : সক্রেটিস।
এই দার্শনিকপ্রবরের সহধর্মিণী তথা স্ত্রী জ্যানথিপি বা জ্যানটিপি। ‘জ্যানথস্’ শব্দের অর্থ হলদে বা হালকা বাদামী আর ‘হিপোস’ শব্দের অর্থ ঘোড়া। এই দুটি গ্রিক শব্দের মিলিত অর্থ হলদে বা হালকা বাদামী রঙের ঘোড়া। গ্রিক ব্যক্তি নামের সঙ্গে ঘোড়ার অনুষঙ্গ খুব স্বাভাবিক, যেমন- ফিলিপোস (অর্থ ঘোড়াদের বন্ধু), হিপোক্রেটিস (অর্থ ঘোড়ার প্রশিক্ষক) ইত্যাদি। অবশ্য প্রাচীন গ্রীসে অভিজাতদের মধ্যে এই ঘোটক অনুষঙ্গ ছিল ঐতিহ্যসমৃদ্ধ। আমাদের তাই অনুমান, জ্যানটিপি নামটি তাঁর বাপের বাড়ির ঐতিহ্যের প্রতি ইঙ্গিত দেয়।
কটা বা সোনালী চুলের জ্যানটিপিও এথেন্সের বাসিন্দা। সক্রেটিসের চেয়ে চব্বিশ বছরের ছোট। জনশ্রুতি, আগে জ্যানটিপির একবার বিয়ে হয়েছিল। তবু কেন সক্রেটিস তাঁকে বিয়ে করলেন? উত্তরে বলা যায়, জ্যানটিপির বিতর্কপ্রিয় স্বভাবের জন্য, যুক্তিপূর্ণ মানসিকতার জন্য সক্রেটিস তাঁকে বিয়ে করেছিলেন। আলাদা যুক্তিও ছিল সক্রেটিসের। কোনও অনুগত, বেচারা প্রাণী তাঁর পছন্দের ছিল না। ঘোড়ার মধ্যে এই বরিষ্ঠ দর্শনশাস্ত্রী তেজস্বিতার সিলমোহর দেখতে পেতেন। যে ব্যক্তি কোনও তেজী, চঞ্চল ঘোড়াকে তাঁর নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সে অন্যদের খুব সহজে আয়ত্তে আনতে সক্ষম ও সফল হবেই। এই বিশ্বাসে ভর করে সক্রেটিস জ্যানটিপিকে বিবাহ করেন। সক্রেটিসের জবানিতে অন্য কথাও শুনি- “মানুষের সঙ্গেই আমার কারবার, বাছ-বিচার না করেই মানুষের সঙ্গে আমি মেলামেশা করতে চাই। তাই স্ত্রীকে (জ্যানটিপি) আমার পছন্দ। বেশ ভালোভাবে জানি, আমি যদি তাঁর মর্জি আর মেজাজ সহ্য করতে পারি তাহলে সহজেই প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে আমি সংযোগ ঘটাতে পারবো”। ঠিকই, জ্যানটিপি বিতর্কপ্রিয়, তর্কবাগীশ হওয়ায় সক্রেটিসের মনের মানুষ। লোকে বলে, এই বিয়ের সুবাদে সক্রেটিস আরও সামাজিকভাবে সক্ষম হয়ে উঠেছিলেন। এছাড়াও কোনও রকম নিপীড়নমূলক পরিস্থিতিতে সক্রেটিস যৌক্তিক বিন্যাসে ঘটনা-পরম্পরাকে বিচার করতে আরও বেশি উৎসুক হয়ে পড়লেন।
![]() |
শিল্পীর কল্পনায় ‘হেমলক’ বিষ পান করছেন দার্শনিক সক্রেটিস |
জ্যানটিপির জন্ম হয়েছিল ৪৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। বনেদী সম্পদশালী পরিবারে জন্মে জ্যানটিপি ১৫-১৯ বছর বয়ঃক্রমের মধ্যে এক সন্তানের মা হয়েছিলেন। এই ঘটনা সক্রেটিসের সঙ্গে বিয়ের আগেই। জ্যানটিপির প্রথম স্বামীর নাম জানা যায় না। দ্বিতীয়বার বিয়ের সময় জ্যানটিপি সক্রেটিসের বাড়িতে বধূ হিসেবে বেশ উল্লেখযোগ্য বরপণ তথা যৌতুকসামগ্রী নিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে ছিল বিপুল পরিমাণ টাকাকড়ি। বাবার পেশা পাথর-খোদাই ছেড়ে সক্রেটিস সেই টাকা লগ্নী করলেন। সক্রেটিস দেখতে কুশ্রী, কদাকার; অন্যদিকে জ্যানটিপিও মেজাজের দিক থেকে কড়া ধাতের। জ্যানটিপির শারীরিক সৌন্দর্যও ছিল না। অর্থাৎ উভয়ের পছন্দ ছিল শারীরিক সৌকর্য-নিরপেক্ষ। এ কথা বাস্তব সত্য, জ্যানটিপি বনেদিয়ানার মানসিকতা নিয়ে চলতেন। এথেন্সের ধনী পরিবারের মেয়ে কি না! একবার সক্রেটিস তাঁর ধনী বন্ধুদের ভোজে আমন্ত্রণ করেছিলেন। সেখানে পরিবেশিত খাবার দেখে জ্যানটিপি লজ্জিত হয়েছিলেন।
সক্রেটিসের সঙ্গে বিয়ের পর জ্যানটিপি তিন পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন- ল্যামপ্রোক্লিস, সোফ্রোনিসকাস ও সেনেক্লেনাস। প্রাচীন গ্রীসে নিয়ম ছিল পরিবারের প্রথম পুত্র সন্তানের নাম মাতামহ বা পিতামহের নামেই রাখার। তবে ওই পূর্বপুরুষের মধ্যে যিনি অধিকতর যশস্বী ও স্বনামধন্য তাঁর নামেই প্রথম সন্তানের নামকরণ হওয়ায় রেওয়াজ ছিল। ভারতে আজকালও অনেক আদিবাসীর মধ্যে প্রচলিত রীতি দাদু বা ঠাকুরদার নাম বংশপরম্পরায় উত্তরসূরিদের পরিচয় হিসাবে রাখা হয়। পারিবারিক আভিজাত্য আর বনেদিয়ানায় জ্যানটিপির বাপের বাড়ি অনেক এগিয়ে থাকায় পরিবারের প্রথম পুত্র সন্তানের নাম ল্যামপ্রোক্লিস রাখা হয়। জ্যানটিপির বাবা ল্যামপ্রোক্লিস সক্রেটিসের বাবা সোফ্রোনিসকাসের চেয়ে অধিকতর প্রভাব, প্রতিপত্তিশালী ছিলেন। এখানে স্পষ্ট, প্রাচীন গ্রীসে সমাজ-পরিবারে পুরুষদের প্রাধান্য ছিল।
প্লেটোর মতে, জ্যানটিপি পবিত্রতা ও স্নেহবৎসল জননী। কিন্তু ঈলিয়ানের মূল্যায়নে, জ্যানটিপি খুব ঈর্ষাপরায়ণ ও ঝগড়ুটে মহিলা। ঈলিয়ান একটি আখ্যানে লিখেছেন, একবার অ্যালসিবিয়াডেস কোনও উপলক্ষে সক্রেটিসকে একটি বড়ো সুন্দর কেক পাঠান। জ্যানটিপির হাতে আসতেই আস্ত কেকটি তিনি পায়ের তলায় পিষে নষ্ট করে দেন। সহনশীলতা তাঁর বেশ কম ছিল। ঈর্ষা ছিল প্রবল। সক্রেটিস তাই বুঝি বললেন এবং বিশ্বাস করতেন, “যেমন করেই হোক বিয়ে করো। যদি তোমার ভালো স্ত্রী জোটে, তুমি সুখী। আর যদি খারাপ জোটে, তুমি একজন দার্শনিক হয়ে যাবে”। সক্রেটিস দার্শনিকই হয়ে গেলেন।
একবার ঘরে খাবার বাড়ন্ত দেখে জ্যানটিপি স্বামীকে গালমন্দ করতে লাগলেন। স্বামী স্থিতধী ও নির্বিকার। কারণ স্বামী সক্রেটিসের বিশ্বাস- একজন ক্রদ্ধ ব্যক্তি পশুরও অধম। চুপচাপ বসলেন গিয়ে ঘরের বাইরের দিকে চৌকাঠে। জ্যানটিপি এ সব দেখে এক বালতি জল স্বামীর মাথার উপর ঢেলে দিলেন। পথিকেরা দেখে হো-হো হেসে উঠলো। তাঁদের সঙ্গে সক্রেটিসও হাসতে শুরু করলেন আর বলে গেলেন, “বজ্রপাতের পর বৃষ্টি নামে”।
সক্রেটিসের জীবন কাহিনীতে এক গ্রন্থাকার লিখেছেন একটি মজার বৃত্তান্ত। সক্রেটিসকে একবার শিষ্য-বন্ধু অ্যালসিবিয়াডেস বললেন, “জ্যানটিপির ভৎসনা অসহ্য”। সক্রেটিস দাবি করলেন, “না, এতে আমি অভ্যস্ত। ঠিক যেমনটি চরকির একটানা খুটখুট শব্দের সঙ্গে। কই, তুমি তো রাজহংসীদের প্যাঁকপ্যাঁক ডাকে কিছু মনে করো না!” “না”, জাবাব দিলেন অ্যালসিবিয়াডেস, “কিন্তু ওরা তো আমাকে ডিম আর ছানাপোনার জোগান দেয়”। জবাবে সক্রেটিস বললেন, “আর জ্যানটিপি আমার সন্তানদের মা”।
জ্যানটিপির সহিষ্ণুতা না থাকলে খেয়ালি দার্শনিক স্বামীর বেয়াদবি চলতো না। মানতেই হয়, ফাঁদ ছাড়া বকের মতো সক্রেটিসের দিনযাপন। সাংসারিক দুশ্চিন্তা জ্যানটিপির রুক্ষ মেজাজের কারণ। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯-এ সক্রেটিসের হেমলক বিষ খেয়ে কারাগারে শহীদ হওয়ার দৃশ্য অশ্রুভরা চোখে জ্যানটিপি দেখেছেন।
Advertisement