Advertisement
সজয় পাল : আমি কখনও একান্নবর্তী পরিবারের স্বাদ পাইনি। বাবার কর্মসূত্রে প্রায়ই কয়েক বছর অন্তর আমাদের স্থান পরিবর্তন করতে হত। তাই বাবা মাকে ছাড়া আমাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে আমি তেমন সময় কাটাতে পারিনি। দিনের বেশির ভাগ সময়ই মায়ের সাথে কাটাতাম। সংসারের কাজে মাকে সাহায্য করা তো দূরের কথা, সারাক্ষনই বিরক্ত করে চলতাম। তাই মা আমাকে শান্ত করতে মাঝে মাঝেই কিছু উদ্ভট বুদ্ধি বের করত।
একবার পুকুর ঘাট থেকে ফেরার পথে আমার জন্যে একটা জলফড়িং ধরে এনেছিল। ফড়িংটার হলুদ-কালো ডোরা কাটা লম্বা লেজের সাথে সুতো বেঁধে বারান্দার গ্রিলে আঁটকে রেখেছিল। ফড়িংটা যতবার উড়তে চাইছিল, সুতোয় টান খেয়ে বারবার মাটিতে আছড়ে পড়ছিল। কিছুতেই ছাড়া পাচ্ছিল না। আমি সেদিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারাক্ষণই ফড়িংটাকে নিয়ে পড়েছিলাম। মাকে বিরক্ত করার কথা একবারও মনে আসেনি। তখন ফড়িংটা ছিল আমার কাছে এক অদ্ভুত প্রাণী, ঠিক আমার প্লাস্টিকের খেলনা হেলিকপ্টারের মত। তারপর থেকে প্রায়ই মাকে বলতাম জলফড়িং এনে দিতে। মা-ও খুশি হয়ে এনে দিত। এতে আমারও যেমন খেলার সঙ্গী জুটে যেত, মা-ও ঠিক সময়ে সংসারের কাজ গুছিয়ে নিতে পারত।
সেই থেকে জলফড়িংয়ের সাথে আমার সখ্যতা অতি নিবিড়। আজও চলার পথে যদি কোনও জলফড়িংয়ের সাথে দেখা হয়, দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে তার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করি।
আমরা সাধারণ ভাবে যাকে জলফড়িং নামে চিনি, ভাল কথায় তাকে গয়াল পোকা বলে, তাকেই ইংরেজিতে বলে ড্রাগনফ্লাই। ড্রাগনফ্লাই-এর জন্ম বৃত্তান্ত জানতে হলে আমাদের যেতে হবে প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগের পৃথিবীতে, ডাইনোসরের যুগে। বিশালাকার প্রাণীগুলো যখন পৃথিবীর মাটি দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল, তখন অন্য পতঙ্গদের সাথে আকাশের দখল নিতে ব্যস্ত ছিল গ্রিফেনফ্লাই। ফসিলস্ থেকে জানা যায় গ্রিফেনফ্লাই-এর ডানার আকার ছিল প্রায় আড়াই ফুট। খুবই হিংস্র স্বভাবের এই প্রাণীরা ছিল মূলত মাংসাশী। এই গ্রিফেনফ্লাই-ই পরবর্তী ৩০০ কোটি বছর ধরে বারংবার যুগ পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে, শারীরিক অভিব্যক্তি ঘটিয়ে আজকের ড্রাগনফ্লাই বা গয়াল পোকা বা জলফড়িং হয়ে বেঁচে আছে। বর্তমানে এদের ডানার আকার মাত্র দুই থেকে পাঁচ ইঞ্চি প্রায়।
জলফড়িংরা সাধারণত শীতল জলাশয়ের কাছাকাছি থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। কারন জলেই যে তাদের জন্ম। স্ত্রী জলফড়িংরাজলের উপরি অংশে বা ছোটো ছোটো জলজ উদ্ভিদের উপর একবারে কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার ডিম পাড়ে। অধিকাংশ ডিমই নানান কারনে নষ্ট হয়ে যায়। বাকি ডিমগুলি কিছুদিন পর ফুটে লার্ভা-ই পরিণত হয়। তারপর ধীরে ধীরে শারীরিক পরিবর্তনের মাধ্যমে পা, ডানা, মাথা গজিয়ে পূর্ণাঙ্গ জলফড়িং-এররূপ পাই।
জলফড়িংদেরদৃষ্টি শক্তি অত্যন্ত প্রখর। মাথার প্রায় ৭০% অংশ নিয়ে ওদের চোখের অবস্থান। পুঞ্জাক্ষি বিশিষ্ট চোখ দুটিতে প্রায় ৩০,০০০ লেন্স অবস্থান করে। ৩৬০ ডিগ্রি কোণ থেকেও এরা দিব্যি দেখতে পাই। তাই তারা সহজেই শিকারিদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে পারে। আবার মানুষের মত এরা সব রঙ দেখতেও পাই। তাই শিকার ধরাও খুব সহজ হয়ে যায়।
এদের ডানা খুব শক্ত, স্বচ্ছ আর খসখসে। তাই এরা যেমন প্রচণ্ড গতিতে উড়তে পারে, জল বা বাতাসেও এদের ডানার কোনও ক্ষতি হয় না। ওড়ার সময় এরা অত্যন্ত দ্রুত উপর-নিচে, পাশাপাশি বা আগে-পিছে নিজেদের ঘোরাতে পারে। এমনকি খুব দ্রুত ওড়ার সময়েও এই কাজগুলি সহজেই করতে পারে। আবার কখনও কখনও এরা খোলা বাতাসে উড়ন্ত অবস্থায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এমনকি খুব তাড়াতাড়ি U-টার্নও নিতে পারে। ওড়ার সময় এদের গতি প্রায় ৩০ মাইল/ঘণ্টা।
জলফড়িংদের পূর্বপুরুষ অর্থাৎ সেই ডাইনোসর যুগের গ্রিফেনফ্লাই আগেই বলেছি খুব হিংস্র ছিল। বাতাসে কার রাজত্ব চলবে তাই নিয়েই সর্বক্ষণ তাদের ঝামেলা চলত। তিনশো কোটি বছর ধরে তাদের শরীর ও স্বভাবের নানা পরিবর্তন ঘটলেও হিংস্রতা কিন্তু তারা আজও ছাড়তে পারেনি। পৃথিবীতে যত রকম যুদ্ধবাজ পতঙ্গ আছে, জলফড়িংরা তাদের মধ্যে সেরা। পুরুষদের হিংস্রতা স্ত্রীদের তুলনায় বেশি। তারা একে অপরকে একদমই পছন্দ করতে পারে না। নিজেদের মধ্যে লড়াই নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা। মাঝেমাঝে লড়াই এতটাই তীব্র হয় যে একপক্ষের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সেই লড়াই চলতেই থাকে। লড়াই বাধে মূলত খাবার বা নিজের এলাকা দখল নিয়ে। বন বা কোনও জলাশয়ের ধারগুলির নির্দিষ্ট কিছু অংশ আলাদা আলাদা জলফড়িং-এরজন্য বরাদ্দ থাকে। অবশ্য অনেক সময় নিজের চিহ্নিত এলাকায় তার পরিচিত অন্য জলফড়িংকে কিছুক্ষনের জন্য তারা থাকতেও দেয়। তবে অচেনা কাউকে দেখলেই যুদ্ধ অনিবার্য।
জলফড়িংদের একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে, আর তা হল তারা তাদের নিজেদের শরীরের তাপ নিজেরাই নিয়ন্ত্রন করতে পারে। তাই পরিবেশের যে কোনো উষ্ণতায় তারা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারে। এ ব্যপারে তারা তাদের শারীরিক গঠনকে বিশেষভাবে কাজে লাগায়। পরিবেশের তাপমাত্রা যখন অত্যধিক বেড়ে যায়, তাদের শরীরের উপরি অংশকে বিশেষভাবে সংকোচন ঘটিয়ে খুব দ্রুত ডানা ঝাঁপটাতে থাকে। ফলে বাইরের তাপ দেহের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না। আবার পরিবেশের উষ্ণতা স্বাভাবিকের থেকে কমে গেলে, সোলার পদ্ধতিতে তাদের শরীর উত্তপ্ত করতে পারে। এই পক্রিয়ায় তারা শরীরের উপরি অংশকে প্রসারিত করে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে স্থির হয়ে বসে থাকে। তারপর ডানাগুলিকে এমনভাবে সূর্যের দিকে কোণ করে রাখে, সূর্য রশ্মি ডানায় প্রতিফলিত হয়ে আরও জোরালো ভাবে তাদের শরীরে এসে পড়ে। এবং শরীর ক্রমশ উষ্ণ হতে শুরু করে।
গ্লোবাল স্কিমার জাতের গয়াল পোকারা প্রচরণ করতে প্রচণ্ড ভালবাসে। গ্রীষ্মের মরশুমে ভারতীয় উপমহাদেশে বৃষ্টির অভাবে যখন জলাশয়গুলি শুকিয়ে যায়, তারা খাদ্য ও প্রজননের উপযুক্ত বাসস্থানের সন্ধানে পথে বেরিয়ে পড়ে। মূলত বাতাসের গতিকে কাজে লাগিয়ে আরব সাগর, এমনকি ভারত মহাসাগর পেরিয়ে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত চলে যায়। মজার ব্যাপার প্রায় ১৪,০০০ থেকে ১৮,০০০ কিলোমিটারের এই দীর্ঘ যাত্রা পথ তারা এক প্রজন্মে শেষ করতে পারে না। ৪-৫ প্রজন্ম ধরে চলে তাদের এই প্রচরণ। আবার বর্ষার মরশুমে তারা নির্দিষ্ট পথ ধরে নিজেদের পুরনো বাসস্থানে ফিরেও আসে।
এখনও পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার প্রজাতির জলফড়িং-এর সন্ধান পাওয়া গেছে। সমস্ত প্রজাতিকে আবার বেশ কয়েকটি শ্রেণীতে এবং প্রত্যেক শ্রেণীকে কয়েকটি উপশ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। যেমন:– অ্যাসনোইডিইয়া (অ্যাসনিডাই, অষ্ট্রোপ্যাটেলিডাই, গমফিডাই, পেটালুরিডাই), করডুলেগ্যাসট্রোইডিয়া (ক্লোরোগমফিডাই, করডুলেগ্যাসট্রিডাই, নিওপেটালিডাই), লিবেল্লুলোইডিয়া (করডুলিডাই, লিবেল্লুইডাই, ম্যাক্রোমিডাই, স্যিন্থেমিস্টেডাই) প্রভৃতি। উপশ্রেণীগুলিকেও রঙ এবং বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বর্তমানে আরও কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
বিশেষ কয়েক প্রকার জলফড়িং :-
১) স্কিমার :-লিবেল্লুইডাই-এর ১০৫টি প্রজাতির মধ্যে স্কিমার অন্যতম। খুব ধীর গতিতে প্রবাহিত পরিষ্কার জলাশয়ের ধারগুলির ছোটো ছোটো ঝোপে এদের নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। স্কিমারদের প্রায় ২৬টি প্রজাতি লক্ষ্য করা গেছে।
২) ডারনার :- ডারনার অ্যাসনিডাই প্রজাতির অন্তর্গত। চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় কালো শরীরের উপর নীল রঙের ছিটে। সাধারণত পুকুর, স্রোত যুক্ত নদী বা দীঘির ধারে এরা অবাধে ঘুরে বেড়ায়। এদের প্রায় ৪০টি প্রজাতি আছে।
৩) স্পিকেটেইলস :- শারীরিক আকৃতিতে বৃহদাকার জলফড়িং পরিবার হল করডুলেগ্যাসট্রিডাই। এদের ৯টি প্রজাতির মধ্যে স্পিকেটেইলস একটি। কালো শরীরের উপর আড়া-আড়ি হলুদ দাগ এদের চেনার সবচেয়ে সহজ উপায়।
৪) পিটেলটেইল :- ফসিলস থেকে জানা যায় পিটেলটেইল সবচেয়ে পুরনো প্রজাতির জলফড়িং। এদের জন্ম হয়েছিল আনুমানিক প্রায় দেড় লক্ষ বছরেরও আগে। বর্তমানে এদেরকে পেটালুরিডাই পরিবারে রাখা হয়েছে।
৫) এমারেল্ড :-করডুলিডাই পরিবারের অন্তর্গত প্রায় ৫০টি প্রজাতির মধ্যে অন্যতম এই সবুজ চোখ বিশিষ্ট এমারেল্ড। বছরের বেশিরভাগ সময় এরা গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। বসন্ত শুরু হতেই বেরিয়ে পড়ে জঙ্গল থেকে। তারপর ছোটো ছোটো জলাশয়গুলিকে কেন্দ্র করে অবাধে ঘুরে বেড়ায় প্রজনন আর শিকারের জন্য।
অবশেষে বলি, জলফড়িংরা খুব ভাল শিকারি পতঙ্গ হিসাবেও পরিচিত। উড়ন্ত অবস্থাতেই তারা শিকার ধরতে বেশি পছন্দ করে। শিকার ধরার কৌশল হিসেবে তারা নিজেদের ওড়ার গতিকে বিশেষভাবে কাজে লাগায়। খাদ্য তালিকায় তাদের প্রথম পছন্দ মশা। সারাদিনে একটা জলফড়িং একাই গড়ে ৩০টা থেকে ১০০টা মশা খেয়ে ফেলতে পারে। এমনিতেই আমাদের দেশে জলফড়িং সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থাই নেই। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার রূপে তাদের আমরা সমাজে টিকিয়ে রেখে যদি ব্যবহার করি, তবে ক্ষতি কি?
Advertisement