Advertisement
বিজয় ঘোষাল :বীরভূম জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থান করছে ছোট্ট একটি জনপদ, গুনুটিয়া। মাঝে শুষ্ক ময়ূরাক্ষী নদী। অন্য প্রান্তে আমড়া, মালঞ্চ, চন্দ্রহাট প্রভৃতি গ্রাম। এই আমড়া গ্রামে ছিল জেলার তথা দেশের প্রথম রেশম কারখানা। কারখানাটি আজ জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। কারখানা সংলগ্ন প্রাচীর থেকে প্লাস্টার খুলে পড়ছে ও তার গায়ে আশ্রয় নিয়েছে বট ও অশ্বত্থ গাছ। সামনে প্রকাণ্ড লোহার কালো গেট আজও বিদ্যমান। ভিতরে বেড়ে উঠছে বন-জঙ্গল।
কারখানাটি একবারে, একদিনে গড়ে ওঠেনি। ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে, একাধিক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় একটু একটু করে স্থাপিত হয়েছিল।
অতীতে বীরভূমের এই সমস্ত অঞ্চল ছিল বন্ধ্যা, জনমানবহীন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে তাঁদের বাণিজ্য বিস্তারে অনুমতি পেলে, বীরভূম পাশ্চাত্য বণিকদের কাছে শিল্প সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পায়। বণিকরা এদেশে আসার আগে বীরভূমের স্থানীয় তাঁতিরা ‘গড়া কাপড়’ উৎপাদন করত। যা জাহাজ ও নৌকার পাল হিসেবে ব্যবহৃত হত। এই সমস্ত কাপড়ের চাহিদা বিদেশের বাজারেও ছিল যথেষ্ট।
তাই বণিকরা দ্রুত এই শিল্পে তাঁদের বিনিয়োগ ও মনোনিবেশ বাড়াতে থাকে। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে স্কটিশ, ওলন্দাজ, ফরাসি, ইংরেজ বণিকরা বীরভূমে আসতে শুরু করে। এদের সবারই গুনুটিয়ায় ময়ূরাক্ষীর উত্তর তীরের জায়গাটি পছন্দ হয়। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক শ্রেষ্ঠতার গুণে এলাকাটি দখলে আসে ইংরেজ বণিক, অর্থাৎ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির।
১৭৮৩ সালে এডওয়ার্ড হে-কে ময়ূরাক্ষী নদী তীরবর্তী অঞ্চলে রেশম চাষের জন্য নিয়োগ করে কোম্পানি। কিন্তু পরে রেশম চাষ তদারকির জন্য মিঃ ফ্রুসার্ডকে কোম্পানি পর্যবেক্ষণের জন্য প্রেরণ করে। ফ্রুসার্ড ব্যবসায়িক প্রতিনিধি হয়ে নগদ ২০ হাজার টাকায় হে সাহেবের কাছ থেকে গুনুটিয়ার রেশম অঞ্চলের মালিকানার স্বত্ব কিনে নেন।
ফ্রুসার্ড সাহেব ১৮৮৫ সালে গুনুটিয়াতে একটি কুঠি তৈরি করেন এবং স্থায়ীভাবে গুনুটিয়ার রেসিডেন্ট হয়ে থাকতে শুরু করেন। তিনি সেকালে চার আনা বিঘে প্রতি জমির পরিবর্তে বারো আনা খাজনার বিনিময়ে জমির বন্দোবস্ত করেন। যা ছিল তাঁর সবচেয়ে অবিবেচনার প্রসূতি সিদ্ধান্ত। তিনি সর্বমোট ২৫০০ বিঘা বন-জঙ্গল আচ্ছন্ন জমি পরিষ্কার করে রেশম চাষের সিদ্ধান্ত নেন এবং উৎপাদন পদ্ধতিতে ইতালীয় প্রযুক্তি অনুসরণ করেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক ভাড়া করে এনেছিলেন সে সময়ে।
কিন্তু এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি রেশম শিল্পে জোয়ার আনতে পারেননি। যার অন্যতম বড় কারণ ছিল ময়ূরাক্ষীর বন্যা। পরে নিজস্ব ব্যয়ে কারখানার চতুর্দিকে খুব উচু করে দুর্গের মতো প্রাচীর তোলেন। এতে প্রচুর টাকা লোকসান হয়। তবুও তিনি দমে যাননি। উৎপাদের মাত্রা বাড়াতে ২০০টি লৌহ ভাণ্ড বসান। এরপরই তিনি দেউলিয়া হয়ে পড়েন। রেশম শিল্পে যে টাকা তিনি বিনিয়োগ করেছিলেন, তার থেকে মুনাফা হিসেবে কিছুই পাননি। ঊর্ধ্বতন কর্মচারী, জেলাশাসক ও শ্রমিকদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন।
শেষে নিরুপায় হয়ে লর্ড কনওয়ালিসকে চিঠি লেখেন, সরকার বাহাদুর যেন তাঁর সমস্ত খাজনা মুকুব করে দেন। তিনি অত্যধিক হারে খাজনা নিয়ে ভূমি গ্রহণ করেছেন। যার বেশিরভাগই জঙ্গল কাটতে এবং বন্যার জল আটকাতে ব্যয় হয়ে গেছে। তিনি আরও লেখেন, প্রায় দশ বছর দেশ ত্যাগ করে তিনি গুনুটিয়াই পড়ে আছেন। অথচ দেশে ফিরে যাওয়ারও তাঁর এখন কোনও সংস্থান নেই। পরে কর্নওয়ালিস সাহেবের হস্তক্ষেপে তাঁকে বকেয়া রাজস্ব থেকে মুক্তি দেন সরকার বাহাদুর।
এরপর ফ্রুসার্ড আর রেশম শিল্পে অর্থ বিনিয়োগ করেননি। জীবনের বাকি বছরগুলো পল্লী অঞ্চলে সম্পদ বৃদ্ধিতে মানুষকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, বীরভূমের রেশম চাষ এবং রেশম শিল্পের প্রথিকৃত ছিলেন এই ফ্রুসার্ড সাহেব। ১৮০৭ সালে তিনি মারা যান।
ফ্রুসার্ড সাহেব দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর সোনামুখীর কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট জন চিপ ৩৪১৫ টাকা বার্ষিক খাজনার বিনিময়ে কাঁচা রেশম উৎপাদন ও রেশম ব্যবসার দায়িত্ব নেন। গুনুটিয়া কুঠিতে আসার আগে তিনি বীরভূমের সুরুলে ছিলেন। এই চিপ সাহেবই ছিলেন বীরভূমের নীল ও লাক্ষা শিল্পেরও প্রথিকৃত। তখনকার সময়ে ইলামবাজার ও দারোন্দা ছিল যথাক্রমে লাক্ষা আর নীল চাষের প্রধান ঘাঁটি। এখানে চিপ সাহেবের ‘নীল কুঠি’টি আজও ‘চিপ কুঠি’ নামে পরিচিত হয়ে আছে।
যায় হোক, জন চিপের হাত ধরে গুনুটিয়ার রেশম শিল্পের অপ্রত্যাশিত সমৃদ্ধি ঘটতে থাকে। এই সময়ে ইউরোপে ফরাসিদের সাথে যুদ্ধের ফলে ইংল্যান্ড থেকে কাঁচা রেশম আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গুনুটিয়ার রেশম কুঠিরের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ১৮৬৩ সালের হিসাবে বার্ষিক ৭ লক্ষ টাকার রেশম উৎপাদন হতো এখানে। উৎপাদিত কাঁচা রেশমের পরিমাণ ছিল ১৮০০ মন। সেসময়ে গুনুটিয়ার এই রেশম কারখানা ছিল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেশম কারখানা। পলু পোকা প্রতিপালনের জন্য ১৫০০০ জন এবং সুতো নিষ্কাসনের জন্যে প্রায় ২৮০০ জন শ্রমিক নিযুক্ত ছিল।
এদিকে রেশম চাহিদা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, স্থানীয় জমিদার ও মধ্য স্বত্বভোগীরা ময়ূরাক্ষী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে ছোট-বড়ো রেশম কারখানা গড়ে তুলতে প্রতিযোগিতায় নামে। পরিবহনের সুবিধার্থে চিপ সাহেব সুরুল-গুনুটিয়া, সুরুল-বর্ধমান, সুরুল-কাটোয়া ও সুরুল-সিউড়ি পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করেন। যে রাস্তাগুলি পরবর্তীকালে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সড়কে রূপান্তরিত হয়।
১৮২৮ সালের ১৬ এপ্রিল গুনুটিয়ার রেশম কুঠিতে চিপ সাহেব মারা যান। এখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
চিপ সাহেবের মৃত্যুর পর মিঃ সেক্সপিয়র রেশম কুঠির দায়িত্ব পান। ১৮৩৫ সালে তাঁর থেকে দায়িত্বভার চলে যায় সরাসরি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। ১৮৩০-৩৩ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দা ও ১৮৩৩ সালের সনদ আইন রেশম শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ১৮৪০ সালের পর রেশম কারখানার অবস্থা আরও খারাপের দিকে গড়াতে থাকে। এরপর চরম আঘাত হানে ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষিত ম্যানচেস্টার কোম্পানি। তাদের তৈরি সস্তা অথচ উন্নতমানের কাপড়ের সাথের অসম প্রতিযোগিতা চলতে থাকে রেশম বস্ত্রের। একে একে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাজারগুলি হাত ছাড়া হতে থাকে। ধীরে ধীরে গুনুটিয়া রেশম কারখানার গুরুত্ব তলানিতে এসে ঠেকতে থাকে। এছাড়াও দাদন ব্যবস্থার সংকট, উৎপাদনের মূল্য বৃদ্ধি, কোম্পানির জুলুম প্রভৃতিও গুনুটিয়া রেশম কারখানার পতনের অন্যতম কারণ বলা যায়।
বর্তমানে এই ১৫ একর জমি সহ সামগ্রিক কুঠি শ্রীহীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এখানে রয়েছে চিপ সাহেবের সমাধি এবং তাঁর ব্যবহৃত আসবাবপত্র, লৌহভাণ্ড ইত্যাদি সেযুগের আরও অনেক দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র ও নথিপত্র। কিন্তু প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ এই ঐতিহাসিক স্থানটির কোনও সংস্কারের ব্যবস্থা করেনি। স্থানটি ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকের উলকুণ্ঠা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত।
Advertisement