এই তো লাল ধুলোয় মোড়া বাউল রঙের বীরভূম

Advertisement
lokp
সুপ্রভাত মুখোপাধ্যায় : পৃথিবীর সৃষ্টি কীভাবে হল, আজও মানুষ তা ভেবে ভেবে অস্থির, এ নিয়ে বিস্ময় বোধ করছে কেবলই। যে যুগের সৃষ্টি রহস্যের তো কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কারও জানা ছিল না। সেই মানব মন নানা দিক থেকে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যাখ্যার পর ব্যাখ্যা করে এসেছে। এই পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার আগে তারও আগে কি ছিল। আসতে আসতে তার কত সব পরিবর্তন। আজ যে পরিস্থিতিতে আমরা বাস করছি সেটাই বা কী! মাটি পাথর পরীক্ষা করে করে আমাদের যাওয়া।
     রাঢ় অঞ্চলের মধ্যেই পড়ছে বীরভূম জেলার মাটি। যে জেলার ভূমির পৃষ্ঠা কোথাও সমতল, কোথাও উঁচু, নিচু, মাঠ, জমি, গ্রাম। কোথাও পাথরময় হয়ে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস। কোথাও কাদা, দোঁয়াশ, বেলে, প্রাচীন পলি মাটি, খড়ি মাটি এই বীরভূমের অন্তরে-প্রান্তরে। বহু প্রাচীন জনপথ এই বীরভূম। ভু-আলোড়নে উঁচু-নিচু এই ঢেউ খেলানো ভূ-পৃষ্ঠের নিচে মুখ বুজে পড়ে আছে পৃথিবীর প্রাচীনতম পাথরের স্তর। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই এখানে খাদ্য উৎপাদনের জন্যে, জনজীবনের জন্যে, কৃষি কাজের জন্যে অনেক জায়গা-জমি ছিল। খাবার-দাবার সংগ্রহেরও নানা উপায় ছিল। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই আদিম জাতি এখানে এসেছিল। তারাই বসতি গড়ে তোলে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য।
     এ জেলার কোথাও দূরে দূরে গ্রাম আর ডাঙা আর মাঝে মধ্যেই রাঙামাটির পথ। ধু-ধু করছে হেতমপুর থেকে রাজনগর, সিউড়ি, রামপুরহাট, নলহাটি, কীর্ণাহার, নানুর, বোলপুর, জয়দেব হয়ে ছোট ছোট গ্রাম ছোঁয়া শহর যেখানে কৃষিই এনেছে সভ্যতার প্রথম ও আদি আলো। এই বাঙালীকে পিছন ধরে রাখলো তার গ্রাম, ছোট ছোট বন-জঙ্গল। যুগ যুগ ধরে তার কত সংস্কৃতি। শাখায় শাখায় ছড়িয়ে রয়েছে লোকসংস্কৃতি। বীরভূমের স্বতঃস্ফূর্ত মনের প্রকাশ তার বাউলেই যেন। বাউল তাদের গানের মধ্যে দিয়ে পরমাত্মার সঙ্গে এক দিব্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে এসেছে। পরমাত্মাকে তারা প্রিয়তম এবং হৃদয়ের অন্তস্থলের একান্ত বলে মনে করে। তারা তো পূজা আচার পালন না করেই পরিপূর্ণ একটা মিলনের সহবস্থান উপলব্ধি করে থাকেন। তাঁর মধ্যে একটা মহা উপলব্ধির বিষয় সে তো তাদের ‘মনের মানুষ’এর সন্ধান! সেই বিস্ময়ের ভেতরেই কোথাও যেন পরম্পরার খোঁজ করে যাওয়া রাঙামাটির পথ ধরেবাংলার পল্লীপ্রকৃতির সহজসরল রূপই বাংলার সংস্কৃতির জন্মদাতা
     বীরভূম মানেই হচ্ছে কত কত গ্রাম যেখানে ছোট ছোট শহরগুলি গ্রামের ওপর নির্ভর করে চলেযা কিছু বাজার বা হাব, মেলা সবই গ্রাম নির্ভার ব্যবসা এখানের মেলা তো বিখ্যাত  একদিকে জয়দেব মেলা তো অন্য দিকে শান্তিনিকেতন মেলা ! তাছাড়া ছোট ছোট কত সব মেলা খেলার এই দেশ – মাটি —, কঙ্কালিতলা, বক্রেশ্বর-এর মেলা, পাথরচাপড়ির মেলা, পাহাড়পুরের দশহরার মেলা এসব তো আছেই। তার মধ্যে সর্বজন প্রিয় জয়দেব কেঁদুলির মেলা আর শান্তিনিকেতন ৭ই পৌষের মেলার বৈচিত্রই আলাদা। অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে এখন আরও শ্রীবৃদ্ধি হয়ে চলেছে দিনের পর দিন। অর্থাৎ বীরভূম বেশ মেলা-খেলার দেশ বটে! রজকিনী রামীর স্মৃতি রক্ষার্থে দোল পূর্ণিমায় মেলা বসে নানুরের দেঁতা পুকুরের পাড়ে। সেই পুকুরের পাড়ে আজও সুরক্ষিত আছে রামীদেবীর কাপড় কাচার পাটাটি। আজ তা পাথর হয়ে আছে। সেই সব কাহিনি আজ পূজিত হচ্ছে। চলেছে সেই কবি-জীবন কাহিনি সঙ্গীতেএ জেলার মানুষ মেলা, যাত্রাপালা, কীর্তনে, হাবু গানে, শ্রী হরনাথ গুপ্ত মহাশয়ের লেটো গানে, বাউল, ফকিরী কত কত ভাবে বিনিময় করে মিলিত হয়েছে। সময়ের হদিস দিতে পারবে একমাত্র সময়ই!
     আজকেও Whatsapp, Facebook, Googleএ বিস্তার পেয়ে আরও যেন সব কিছু নিয়েই পৌঁছে যাচ্ছে গ্রামীণ সব সংস্কৃতি অন্যদিকে সাঁওতালী সঙ্গীতের সুরবাদ্য এই রাঙা মাটির পথে ঘোর লাগিয়ে দিতে পারে যেমন বীরভুমের মানুষের আচার আচরণে কোথায় এই সব আদিবাসী মানুষের সুর ভাসে কথায় গানে কোনও এক দিকশুন্যপুরের টান। ছোট ছোট কাঁটা ঝোপ, নদী, নালা পার হয়ে শীত রোদ্দুর ছড়ানো গ্রাম।
     বির অর্থাৎ জঙ্গলময় অঞ্চল। বির এবং হড় অর্থাৎ জঙ্গলময় ও মানুষ এই দুই-এর মিশ্রণে বিরহড়। শোনা যাচ্ছে — এই বির পরবর্তী সময়ে অন্য এক মানে করছে — কথায় কথায় — বির আর্থৎ সাহসের প্রতীক এক দিকবলয় তার কার্যকলাপেই বীরাচার সাধনার স্থানই বীরভূম।
কত সব পুরনো লোক কথা কাহিনি নিয়েই বীরভূমের রাঙা মাটির পথ-প্রকৃতি। এই রাঙা মাটির দেশে একটা সহজিয়া ভাব বিনিময়ের প্রকাশ এ মাটির  হাওয়াই হাওয়াই। সাধারণত কৃষিজীবী মানুষের এক সময়ের চিত্ত-বিনোদনের একটা প্রধান মাধ্যমই ছিল যাত্রাপালা। জয়দেব পদ্মাবতীর জীবন, রামী চণ্ডীদাসের জীবন, বেহুলা লখিন্দর এরকম কত কত কাব্য-কাহিনি নিয়ে যাত্রাপালা হোক কবিগান, পটচিত্র, বহুরূপী সাজ, পাহাড়পুরের দশহরা মেলার মনসা গান আজও মনে ভাসছে। কঠিন জটিল জীবনের মধ্যেও ওই সব সহজিয়া উৎসব আজও খুঁজছে পরম্পরা বাহিত আমাদের প্রাণ।
     বিচিত্র এই মিলন ভূমি রাঢ়দেশ বীরভূম। চারিদিকে ধু-ধু রাঙা পথ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পাশাপাশি মিলিত গোষ্ঠীর নিবিড় সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ এ জীবন কত কাল ধরে। প্রধানত শান্তিনিকেতন এবং শ্রীনিকেতন বা বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করে এ জেলার পরিচিতিই জগৎব্যাপী। বাংলা এবং বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— তাঁর সাহিত্য রচনা, পল্লী–উন্নয়ন আরও কত কত কাজ মানুষ যা যা জানেন — সে সবের কত কিছুই তো এই বীরভূমেই বসে করে গেছেন। তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার এই রাঙা মাটিই তাঁর কর্মভূমি। ভাবলে আবাক লাগে কত দূর পৃথিবীর গন্ধে ভরে দিয়েছেন আমাদের! সেদিক থেকে এ বীরভূমে জন্মে এবং বসবাস করে আমাদের আনন্দের শেষ নেই! কত দূর ধু-ধু করছে ধূলিময় বীরভূম। কত যে ভাবনার বীজ নিয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, আরও কত লেখকের দেশ ওই গ্রাম থেকে গ্রামে সৃষ্টির সময় নিয়ে ঘুরেছেন — হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, সুধিরকুমার করণ, আদিত্য মুখোপাধ্যায় ——, রাঙা মাটির পথে পথে মন  ভুলিয়ে; আমার বাউল রঙের বীরভূম আমি তোমায় ভালোবাসি।

Advertisement
Previous articleপ্রকাশিত হল শারদ সংখ্যা “আজকের কবিতা”
Next articleস্বপ্ন দিয়েই শুরু হয়েছিল যাত্রাসিদ্ধি তলার মহোৎসব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here