গণপুর -কে বীরভূমের একটি মন্দিরময় গ্রামও বলা চলে। কারণ সমস্ত গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ২৩টি অতি প্রাচীন মন্দির। অপূর্ব তাদের কারুকার্য। পূর্বে অবশ্য এখানে ৪৬টি মন্দির ছিল। তবে কালে কালে বাকি মন্দিরগুলি হারিয়ে গিয়েছে এর বুক থেকে। এখানকার অধিকাংশ মন্দির অলঙ্করণে সাহায্য নেওয়া হয়েছে ‘ফুলপাথর’-কে। ফুলপাথর টেরাকোটা বা পোড়ামাটির অলঙ্করণ নয়, এটি সহজলভ্য একটি উপদান। যা স্থানীয়ভাবে মোড়াম বা গিরিপাথর বলে।

গণপুর বীরভূম জেলার মল্লারপুর ব্লকের সিউড়ি-মল্লারপুর জাতীয় সড়কের ওপর অবস্থিত একটি জঙ্গল ঘেরা গ্রাম। গ্রামটিকে বীরভূম জেলার অন্যতম একটি প্রাচীন সম্ভ্রান্ত গ্রামও বলা চলে। কারণ সমগ্র গ্রামের ছত্রে ছত্রে মিশে রয়েছে প্রাচীন আভিজাত্যের ছবি। প্রকৃতির নির্মলতা আবিষ্ট করে রেখেছে সমগ্র গ্রামকে। গ্রামটির সবচেয়ে বেশি পরিচিতি অবশ্য তার বিস্তৃত সুগভীর সবুজ বনভূমির জন্য।
গণপুর -কে বীরভূমের একটি মন্দিরময় গ্রামও বলা চলে। কারণ সমস্ত গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে ২৩টি অতি প্রাচীন মন্দির। অপূর্ব তাদের কারুকার্য। পূর্বে অবশ্য এখানে ৪৬টি মন্দির ছিল। তবে কালে কালে বাকি মন্দিরগুলি হারিয়ে গিয়েছে এর বুক থেকে। এখানকার অধিকাংশ মন্দির অলঙ্করণে সাহায্য নেওয়া হয়েছে ‘ফুলপাথর’-কে। ফুলপাথর টেরাকোটা বা পোড়ামাটির অলঙ্করণ নয়, এটি সহজলভ্য একটি উপদান। যা স্থানীয়ভাবে মোড়াম বা গিরিপাথর বলে। গুণগত মানে ফুলপাথর অনেকটাই টেরাকোটার সমধর্মী।
গণপুর -এর সরকার পাড়ায় রয়েছে একত্রিত ৫টি শিব মন্দির। যাদের ৪টিকে চারচালা ও ১টিকে দেউল রীতিতে নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরগুলির কারুকার্য দেখলে সত্যিই অবাক হতে হয়। হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে, অলংকরণে হয়তো টেরাকোটার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তেমনটি নয়। ফুলপাথরের অসামান্য ও সূক্ষ্ম অলঙ্করণে মন্দিরগুলির সমস্ত শরীর সাজিয়ে তোলা হয়েছে একাধিক পৌরাণিক ও সামাজিক ঘটনাবলীতে। জানা যায়, গণপুর -এর এই ৫টি শিব মন্দির নির্মাণ করেছিলেন চৌধুরী বংশের অকিঞ্চিন চৌধুরীর পুত্র ও পৌত্ররা।
এই ৫ শিব মন্দির পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে মন্দির ঘেরা একটি প্রাচীন প্রাঙ্গণ। এখানে রয়েছে আরও ১৪টি শিব মন্দির। টিনে ছাওয়া একটি কালীর বেদীকে কেন্দ্র করে এই ১৪টি শিব মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে এখানে। বেদীটির পূর্বদিকে ৭টি, পশ্চিমদিকে ৪টি ও উত্তরে ৩টিকে রেখে সাজানো হয়েছে এই শিব মন্দিরগুলিকে। এখানে প্রতিটি মন্দির সাজিয়ে তোলা হয়েছে আশ্চর্যরকম সুন্দর অলঙ্করণে। অলঙ্করণে সাহায্য নেওয়া হয়েছে টেরাকোটা ও ফুলপাথরকে। সেই অলঙ্করণে ফুটে উঠেছে ঢেঁকিতে চাল ভাঙা, রাম-বারণের যুদ্ধ, বিষ্ণুর দশাবতার, মহিষাসুরমর্দিনী এই রকম সমাজ, প্রকৃতি, পুরাণ সহ একাধিক দৃষ্টি নন্দন দৃশ্য।
উত্তরের মন্দিরগুলির কাছে চারটি থাম যুক্ত একটি সুউচ্চ দোলমঞ্চও নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে টেরাকোটা ও পঙ্খের অলঙ্করণ দেখা যায়। এর সামনের অংশে রয়েছে রাসচক্র ও রথের মধ্যে অধিষ্ঠিত নারী পুরুষের চিত্র। নিচের অংশে রয়েছে লতা-পাতা, নৌকাবিলাস, রাধাকৃষ্ণ-এর প্রতিচ্ছবি মিশ্রিত অলংকরণ। এছাড়াও একটি পালকি আকারের মনসা মন্দিরও রয়েছে এখানে। এটিকে নির্মাণ করা হয়েছে কালী বেদীটির ঠিক দক্ষিণ দিকে।
এর পরেই রয়েছে গণপুর -এর শিবতলা পাড়া। এখানে রয়েছে পরপর ৬টি শিব মন্দির। উচ্চতা বেশি না হলেও প্রাচীনত্বের দিক থেকে এই মন্দিরগুলির গুরুত্ব অনেক। তবে এই মন্দিরগুলি অলঙ্করণ বিহীন। গণপুর -এর লৌহ ব্যবসায়ী চৌধুরীরা এগুলি নির্মাণ করেছিলেন ১৭৬৭ থেকে ১৭৬৯ সালের মধ্যে। সে সময় এই অঞ্চলে চলছিল দুর্ভিক্ষ। তাই মন্দিরগুলি নির্মাণ করতে উড়িষ্যা থেকে আনা হয়েছিল একদল শিল্পীকে। এছাড়াও গণপুর গ্রামে একটি সুউচ্চ পিতলের রথ রয়েছে। যার সারা শরীরে জড়িয়ে রয়েছে আশ্চর্য সুন্দর অলংকরণ।
গণপুর -এর সবচেয়ে পরিচিতি তার সবুজ গহীন জঙ্গলের জন্য। সিউড়ি-মল্লারপুর জাতীয় সড়কের দুপাশ জুড়ে রয়েছে এই মায়াবী বন। বহু পর্যটক প্রতি বছর এখানে বেড়াতে আসেন। তাদের থাকার সুবিধার্থে এখানে একটি বনবাংলোও রয়েছে।
বিস্তৃত বনের ভিতরে রয়েছে সরু পায়ে চলার পথ। দুপাশে দেখা মিলবে শাল, মহুয়া আর সেগুনের সারি। প্রথম দিকে জঙ্গল কিছুটা হালকা। পরে ঘন হয়ে প্রবেশ করেছে বনের গভীরে। এককালে এখানে বাঘ থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা জীবন ও জীবিকার সন্ধানে সারাদিন ঘুরে ঘুরে এখান থেকেই সংগ্রহ করেন শাল পাতা, কাঠ আর মধু।
বহু ইতিহাসের সাক্ষী রয়েছে এই গণপুর জঙ্গল। যদিও পূর্বের থেকে এখন অনেক হালকা হয়েছে এই জঙ্গলের বিস্তৃতি। তবু আজও সমান আকর্ষণ ধরে রেখেছে পর্যটকদের কাছে।