রোজ ভোর ৩টেয় উঠে ১০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এখান থেকেই তিনি পৌঁছে যান আমোদপুর স্টেশনে। তারপর রাতের ট্রেন বা ট্রাকে আসা প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্র, ম্যাগাজিনগুলি গুছিয়ে আবার বেরিয়ে পড়েন পাঠকের দরবারে। সমগ্র আমোদপুর অঞ্চল সহ পুরন্দরপুর ফিরতি পথের দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামগুলির কোনওটিই বাদ যায় না এই খবর ফেরী থেকে। দুর্গোৎসবের চারদিন, স্বাধীনতা দিবস আর প্রজাতন্ত্র দিবসের পরের দিনটি বাদ দিলে দীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে এই নিয়মেই বাঁধা রয়েছে তাঁর ‘খবর ফেরী’-র সংসার। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

বিজয় ঘোষাল : গ্রীষ্ম হোক বা বর্ষা, শরৎ বা শীত, কোনও ঋতুই তাঁকে থামিয়ে রাখতে পারে না। সকালের সূর্য ওঠার অনেক আগেই তাঁকে উঠতে হয় ১০ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়ার জন্য। তারপর দু’চাকার যানটিতে প্যাডেল ঘুরিয়ে পৌঁছে যান নিজের গন্তব্যে। লাটবাঁধা খবরের কাগজ তখনও এসে পৌঁছায় না আমোদপুর স্টেশনে। কাগজ পৌঁছালে, তা নিজের মতো করে গুছিয়ে আবার বেরিয়ে পড়েন ফেরী করতে। এপাড়া ও পাড়া, এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে খবর পৌঁছে দেন অন্যের দুয়ারে। তখনও ঘুম ভাঙে না অর্ধেক পাঠকের। তারপর সমস্ত কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরতেই নজরে পড়ে সকালের সূর্যটা কখন যেন মাথার উপরে চলে এসেছে। এই যাত্রা আজকের নয়, দীর্ঘ ৪৮ বছরের।
কথা হচ্ছে সংবাদপত্র বিক্রেতা ভুবন দে সম্পর্কে। বয়স তাঁর ৬০ পেরিয়ে ৭০-এর কোটায়। বাড়ি বীরভূম জেলার সিউড়ি ২ ব্লকের পুরন্দরপুর গ্রামে। রোজ ভোর ৩টেয় উঠে ১০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে এখান থেকেই তিনি পৌঁছে যান আমোদপুর স্টেশনে। তারপর রাতের ট্রেন বা ট্রাকে আসা প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্র, ম্যাগাজিনগুলি গুছিয়ে আবার বেরিয়ে পড়েন পাঠকের দরবারে। সমগ্র আমোদপুর অঞ্চল সহ পুরন্দরপুর ফিরতি পথের দুই ধারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামগুলির কোনওটিই বাদ যায় না এই খবর ফেরী থেকে। দুর্গোৎসবের চারদিন, স্বাধীনতা দিবস আর প্রজাতন্ত্র দিবসের পরের দিনটি বাদ দিলে দীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে এই নিয়মেই বাঁধা রয়েছে তাঁর ‘খবর ফেরী’-র সংসার।
ভুবন বাবু জানালেন, তাঁর আদি বাড়ি ছিল ময়ূরেশ্বরের রামনগর গ্রামে। পুরন্দরপুর তাঁর পিসির বাড়ি। ছেলেবেলাতেই তিনি চলে আসেন এই পুরন্দরপুরে। তারপর সংসারের হাল ধরতে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই তিনি সংবাদপত্র ফেরী করতে শুরু করেন। যদিও সেই সময় তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল শুধুমাত্র পুরন্দরপুরের মধ্যেই। তারপর আর একটু বয়স বাড়লে তাঁর সীমানা বেড়ে যায় আমোদপুর পর্যন্ত।
তখন সকালের ট্রেনে কাগজ আসত না। আসত বিকালের ‘বারুনি’ লোকালে। কাগজ ছিল তখন তিনটি, ‘অমৃতবাজার’, ‘বর্তমান’ আর ‘যুগান্তর’। ট্রেন থেকে কাগজ নামিয়ে পাঠকদের হাতে পৌঁছে দিতেই সন্ধ্যা পেরিয়ে যেত।
সেই শুরু, আজও চলছে তাঁর পথ চলা। ৪৮টা বছর পেরিয়ে এখন মাথার চুলে পাক ধরেছে। সময়ও কখনও সমান্তরালে চলে না। চড়ায়-উতরায় তাঁর জীবনেও এসেছে। তবুও রোজ নিয়ম করে কাগজ পৌঁছে দিয়ে চলেছেন পাঠকের হাতে। এমনকি চলতি করোনা পরিস্থিতিতেও সবাই যখন দরজা এঁটে লকডাউন পালন করতে ব্যস্ত, ভুবন বাবু তখনও দেশের খবর, দশের খবর পৌঁছে দিয়ে গিয়েছেন মানুষের কাছে।
পুরন্দরপুর থেকে সাইকেল চালিয়ে আমোদপুর পৌঁছাতে তাঁর সময় লাগে গড়ে প্রায় ৫০ মিনিট। ভোর ৩টেয় বেরিয়ে আবার বাড়ি ফিরতে পেরিয়ে যায় দুপুর ১টা। চলতি পথে ক্লান্ত হলে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার শুরু হয় তাঁর পথ চলা। স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ আর দুই মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। চাষের জমি কিছু থাকলেও খবর ফেরীর জন্য সেদিকে সময় দিতে পারেন না তিনি। ছেলেই সেসব দেখা-শোনা করে।
বয়স এখন প্রায় ৭০-এর কোটায়। কিন্তু তাঁর কাছে এ নেহাত একটা সংখ্যা মাত্র। নিত্যদিনের খবর ফেরীতে বয়সের প্রভাব পড়েনি কখনও। আমোদপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষগুলি তাই মাঝে মাঝেই বলে থাকেন, “ভুবন দা না থাকলে যেন সকালটাই বৃথা।”