৪২ এর আন্দোলন এর কথা মনে করিয়ে দেয় বোলপুর রেল স্টেশনের স্মৃতিস্তম্ভটি

Advertisement

৪২ এর আন্দোলন এর সময়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদের আগুন। মহিষঢাল গ্রামের জটা মর্মু, গনেশ হাঁসদা, জেঠা মর্মু ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে গুলিবিদ্ধ হন। যদিও ৪২ এর আন্দোলন এর পিছনে এঁদের অবদানের কথা বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে।


এর আন্দোলন

বিজয় ঘোষাল : বীরভূম জেলার বোলপুর রেলস্টেশন থেকে রবীন্দ্রনাথের কর্মভূমি শান্তিনিকেতনের ব্যবধান মাত্র তিন কিলোমিটারের। এই রেলস্টেশনটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব কিন্তু কিছু কম নয়। ৪২ এর আন্দোলন এ (আগস্ট) স্মৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি। ব্রিটিশদের গোরা সৈন্যদের বন্দুকের সঙ্গে পাশ্ববর্তী গ্রামের শোষিত সাঁওতাল উপজাতি তথা প্রতিবাদী কিছু মানুষের তীর, ধনুক, টাঙ্গি, কুঠারের এক অসম যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও। যা বীরভূম জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনে সাঁওতাল উপজাতিদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এই অসম যুদ্ধে শহীদ হন দুই তরতাজা যুবক। প্রথমজন মোষঢালের জটা মর্মু এবং দ্বিতীয়জন কালিকাপুরের তারাপদ গুই। তাঁদের দেশের হয়ে এই আত্মবলিদানের কথা স্মরণ করেই বোলপুর রেলস্টেশনের বাইরে নির্মিত হয়েছে শ্রদ্ধাঞ্জলী স্বরূপ একটি শহীদ স্মারকস্তম্ভ।

এই শহিদ স্মারক গঠনের জন্য অন্যতম উদ্যোগী ছিলেন কালিকাপুর নিবাসী বিষ্ণুনাথ মুখোপাধ্যায়। এই প্রসঙ্গে তাঁর মত, “ঘটনার স্মৃতি রক্ষার্থে এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মান করেন বিশ্বভারতীর কলাভবনের অধ্যাপক প্রবীর বিশ্বাস।” রাঙামাটির রঙের অসাধারণ শিল্পনৈপুণ্যের সাক্ষী এই স্মৃতিস্তম্ভটি। চিরাচরিত আদিবাসী সমাজের ব্যবহৃত কৃত্রিম অস্ত্র যেমন- তীর, ধনুক ও কুঠারের ছাপ রাখা হয়েছে এটিতে। স্তম্ভটির নীচে থেকে মাঝ বরাবর সাজিয়ে তোলা হয়েছে শাল বৃক্ষের শাখা-প্রশাখায়। স্তম্ভটির একদিকে কোনও যুবকের মুষ্টিবদ্ধ হাত ধরে আছে কুঠার। যা উপজাতি সমাজের বীরত্বের প্রতীককে নির্দেশ করে। স্মারকটির নীচে মার্বেল পাথরে লেখা আছে, “১৯৪২-এর ২৯শে আগস্ট বোলপুর রেলস্টেশনে ব্রিটিশ শাসকের গুলিতে যাঁরা নিহত হয়েছেন – তাঁদের স্মরণে।”

ঠিক তারই নীচে খোদিত আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বহস্তে রচিত, “সুপ্রভাত” কবিতার প্রসাঙ্গিক অংশবিশেষ, “উদয়ের পথে শুনি কার বাণী / ভয় নাই ওরে ভয় নাই / নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান / ক্ষয় নাই তাঁর ক্ষয় নাই।”

বাস্তবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি সেদিনের ৪২ এর আন্দোলন এর সঙ্গে গুরুত্ব পেয়েছে। সেদিনের শত শত সাঁওতালের স্বতঃস্ফূর্ত, আপসহীন, ভয়হীন অংশগ্রহণ ও তাঁদের বলিদান পথ প্রশস্ত করেছিল স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর। কিন্তু কেন এই অসম যুদ্ধ? কেনই বা ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলি চালাতে হল আন্দোলনকারী জনতার ওপর? এই সমস্ত কারণ জানতে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কয়েক দশক আগের সময়ে।

সাল ১৯৪২, তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। হঠাৎ করেই ভারতে অক্ষশক্তি জাপানের আক্রমণের সম্ভবনা প্রবল হয়ে উঠল। তাই তৎপরতার সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার স্যার স্ট্যার্ফোড ক্রিপসের নেতৃত্বে গঠিত একটা কমিটি ভারতবাসীর সাহায্য প্রার্থনা করল। কিন্তু  ক্রিপস প্রস্তাবে পূর্ণস্বাধীনতার উল্লেখ না থাকায়, ভারতবাসীরা তা প্রত্যাখান করে। এদিকে জাপান ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ব্রিটিশও মরিয়া হয়ে উঠছে। সুযোগ বুঝে ভারতীয়রাও ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দিয়ে বসল। বীরভূমে এই ৪২ এর আন্দোলন এর সূত্রপাত হয় ১৩ আগস্ট। সে সময়ে কংগ্রেস জেলা কমিটির সম্পাদক ছিলেন লালবিহারী সিং। ১৫ আগস্ট দুরাজপুরের সুরযুপ্রসাদ ভগতের বাড়িতে কংগ্রেসের গোপন সভা বসে। ঠিক হয়, যতদিন ভারত স্বাধীন না হচ্ছে, ততদিন বীরভূম জেলা কংগ্রের কমিটি জাতীয় সরকারের কাজ করে যাবে।

কোপাই নদী তীরবর্তী জঙ্গল ঘেরা গ্রাম মহিষঢাল বা ‘মোষঢাল’ বোলপুর থেকে আমোদপুর-সাঁইথিয়া যাওয়ার পথেই পড়ে। অস্টিক ভাষায় ‘ডাল’ শব্দের অর্থ ‘পথ’। গ্রামের পশ্চিমে সাহেবগঞ্জ লুপ লাইন চলে যাচ্ছে দক্ষিন থেকে উত্তরে। গ্রামটিতে বেশিরভাগই সাঁওতাল উপজাতির বাস। বর্তমানে প্রায় দুশোটিরও বেশি সাঁওতাল পরিবার এখানে বাস করছে। এদের মধ্যে সরেন, টুডু, মাড্ডি, হাঁসদা, কিসকু, মর্মু পদবীর সংখ্যাই বেশি। সমাজের নিয়ম অনুযায়ী সর্দারের কথায় এখানে শেষ কথা। ১৮৫৫ এর সাঁওতাল বিদ্রোহের আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রেলপথ স্থাপনকালে রাণীশ্বর (বর্তমানে ঝাড়খন্ড) অঞ্চল থেকে কর্ম সূত্রে এরা এখানে চলে আসে। রেলপথ সম্প্রসারণের পাশাপাশি এরা যোগ দেয় পরের জমিতে মুটে-মজুরের কাজে। ১৮৫৯ সালে রেলপথ চালু হলে কেউ কেউ চালকলে কাজ করতেও চলে যায়।

তারও পরে মহিষঢাল ধীরে ধীরে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির আনাগোনা বেড়ে যায়। গঠিত হয় কৃষক, মুজদুর সংগঠন। এই গ্রামেই ৪২ এর আন্দোলন এর সময়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠে প্রতিবাদের আগুন। মহিষঢাল গ্রামের জটা মর্মু, গনেশ হাঁসদা, জেঠা মর্মু ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে গুলিবিদ্ধ হন। যদিও ৪২ এর আন্দোলন এর পিছনে এঁদের অবদানের কথা বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে।

গ্রামে প্রবেশের পর বাঁদিকে ঘুরতেই রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে দেখা যাবে একটা বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ। মাঠের বাঁদিকে আছে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো এক সাঁওতাল যুবকের প্রতিকৃতি। এখানে এখন সিধু-কানহুর ফাঁসির দিনে পুজো দেওয়া হয়। মাঠটির বিপরীতে রয়েছে একটি প্রাথমিক স্কুল, নাম মহিষঢাল মার্শাল ডাহার প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটির পূর্ব নাম ছিল কুঠীপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই নাম পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ৪২ এর আন্দোলন এর অনেক ইতিহাস। ‘মার্শাল’ এবং ‘ডাহার’ শব্দের অর্থ যথাক্রমে ‘আলো’ ও ‘দিশারী’। এই নামটি রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিশিস্ট লেখক অরুন চৌধুরী।

প্রতি বছর ৩০ জুন এখানে সাঁওতাল বিদ্রোহের পূর্তি হিসাবে পালন করা হয় হুল উৎসব। এছাড়াও ২৯ আগস্ট মহিষঢাল গ্রামবাসীরা ও বিশিষ্টজনদের উপস্থিতিতে পালন করা হয় জটা মর্মু শহিদ হওয়ার স্মরণোৎসব। স্মরণ করা হয়ে থাকে গনেশ হাঁসদা, জেঠা মর্মু, বাজন মর্মু, সরেন মর্মুর মত বীর আদিবাসীর কথা।

যদিও জটা মর্মুর স্থায়ী বাস ছিল না মোষঢালে। এখানে তাঁর শ্বশুর বাড়ি ছিল। আসল বাড়ি বল্লভপুরডাঙা। তিনি তীর ধনুক হাতে ইংরেজ পুলিশের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। শোনা যায়, পান্নালাল দাশগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত রূপপুর সাম্যসদনে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য তিনি প্রশিক্ষণ নিতেন।

জটার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব ও অনলস প্রচেষ্টা, গ্রামবাসীদের অনুপ্রাণীত করেছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মৃতি তখনও দগদগে। তাঁরা ভোলেনি, সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সিউড়ির মাঠে প্রকাশ্য দিবালোকে কয়েক হাজার সাঁওতালকে গণফাঁসি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।

যাইহোক, ৪২ এর আন্দোলন এর সঙ্গে কিন্তু যুক্ত ছিল অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সমান্তরালভাবে চলে আসছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। ১৯৩৪, ১৯৩৫, ১৯৪০ ও ১৯৪৩-এর খরা এবং ১৯৩৬, ১৯৩৯ ও ১৯৪২ সালের বন্যার হাত ধরে বীরভূমের অবস্থা তখন মুমূর্ষু রোগীর মতো। ব্রিটিশ সরকার এই পরিস্থিতির মোকাবিলা না করে, যুদ্ধে সেনাবাহিনীদের রসদ জোগাতে ব্যস্ত ছিল। দেশের মানুষের পেটে ভাত নেই, অথচ সরকার সৈন্যদের চাল পাঠাচ্ছে। যা একেবারেই ভাল চোখে দেখেনি দেশবাসী। তাই সেসময় মুটে, মজদুর, গাড়োয়ান, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ সবাই একজোট হয় এই চাল পাচার বন্ধ করার জন্য।

১৯ আগস্ট বোলপুর হাইস্কুলে গাড়োয়ান সমিতির বৈঠকে বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনারায়ণ সেন গাড়োয়ানদের উদ্দেশে বলেন, সমস্ত গরুর গাড়ি বন্ধ রাখতে, যাতে একটি চালও অন্যত্র না যায়। বোলপুর রেলস্টেশনে স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দলকে পাহারার জন্যও রাখা হয়। এদিকে গোপনে খবর আসে, ২৯ আগস্ট বোলপুর রেলস্টেশন থেকে চাল অন্যত্র যাবে। তাই চাল পাচার রুখতে ২৬ আগস্ট আদিত্যপুর গ্রামের শ্রীমতি রাণী চন্দ্র ও অধীর বন্দ্যোপাধ্যায় মোষঢাল এবং পাশ্ববর্তী গ্রামের আদিবাসীদের এগিয়ে আসতে বললেন।

২৯ আগস্ট জটা, জেঠা, খুঁটে মর্মুরা এগিয়ে চললেন বোলপুরের উদ্দেশে। ওই দিন বিশাল জনসুমদ্র “ইংরেজ ভারত ছাড়ো, চাল চালান বন্ধ করো, দেশ কাদের, বোলপুর রেলস্টেশন আমাদের…” শ্লোগান দিতে দিতে বোলপুর রেলস্টেশনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। আতঙ্কিত স্টেশন মাস্টার বর্ধমানে খবর পাঠায়। ছুটে আসে ইংরেজের গোরা সৈন্য। তারা অশান্ত জনতার ওপর গুলি বর্ষন করতে থাকে। গুলিবদ্ধ হন জটা মর্মু এবং কালিকাপুরের তাঁরাপদ গুই।

তারাপদ গুই মাত্র ২২ বছর বয়সে শহিদ হন। তাঁর একটা মিষ্টির দোকান ছিল। চাল পাচার রোখার আন্দোলনে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন। এত কম বয়সে শহিদ হওয়া বীরভূমে সম্ভবত এই প্রথম। পরে তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে একটি শহিদ বেদি নির্মিত হয়েছে কালিকাপুরে।

এই দুজন শহিদ হওয়া ছাড়াও সেদিন তেরো জন আহত হয়েছিলেন। মোষঢালের গনেশ হাঁসদার পায়ে গুলি লাগে। একজন পুলিশ সুপারিন্টেন্ড তীরবিদ্ধ হয়। কয়েক জন গোরা সৈন্য জখম হয়। ৩০ আগস্ট গ্রেপ্তার হলেন নিশাপতি মাঝি, বোমক্যেশ রায়, মণি গাঙ্গুলীরা। রেল সম্পত্তি নষ্ট করার জন্য বি. লাহিড়ীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তাতে ১০ হাজার  punitive tax আদায় করা হয়।

এই ঘটনার স্মৃতিরক্ষার্থে ১৯৯৫ সালে গঠিত হয় শহিদ স্মারক কমিটি। সম্পাদক ছিলেন বিষ্ণুনাথ মুখোপাধ্যায়। এছাড়াও বোলপুরের সেদিনের ঘটনার স্মরণে ২০১০ সালে রামপুরহাট থেকে হাওড়া পর্যন্ত সুপারফার্স্ট ট্রেনটির নাম রাখা হয়েছে “শহীদ এক্সপ্রেস”। প্রতিবছর ২৯ আগস্ট শহিদদের স্মরণ করা হয় বোলপুর রেলস্টেশনে শহিদ বেদীর সামনে।

কোপাই নদী আজও প্রবহমান, সেদিনের মোষঢালের সাঁওতাল জনজাতির ব্রিটিশের অন্যায় নীতির ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ইতিহাস বইয়ে অলিখিত থাকলেও জটা মুর্মু, গনেশ হাঁসদা, খুঁটে মর্মুদের বীরত্বে গাঁথা জীবিত মৌখিক ইতিহাস হয়ে।

Advertisement
Previous articleতারাশঙ্কর : বীরভূম সাহিত্য পরিষদের শতবার্ষিকী সভাকক্ষে আলোচনা সভা
Next articleChandrayaan 3 : ইসরোর সাফল্যে ইতিহাস তৈরি করল ভারত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here