Advertisement
বিদিশা মিত্র : জল জীবন ধারণের একটি মৌলিক চাহিদা। আপাতদৃষ্টিতে এই পৃথিবী জল সম্পদে সমৃদ্ধ হলেও গ্রহণযোগ্য জলের পরিমাণ ক্রমশ ক্ষীয়মাণ। পৃথিবীতে মোট জলের ৯৭.৫ শতাংশ লবনাক্ত, যা পানের উপযুক্ত নয়। বাকি ২.৫ শতাংশ মিষ্টি বা মিঠা জল। এই জল পানের উপযুক্ত, যাকে পানীয় জল বলা হয়। যদিও এই মিষ্টি জলও এখন আর সহজলভ্য নয়।
সারা পৃথিবী জুড়ে ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এই পানীয় জল। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এই হ্রাসের অন্যতম কারণ। কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে জলের যথেচ্ছ ব্যবহার, অগভীর নলকূপের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মনুষ্য দ্বারা সৃষ্টি বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে দ্রুত বাষ্পীভবন বর্তমানে জলের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে অসমতা সৃষ্টি করছে।
এই জল সঙ্কটের আবার সঙ্গে দোসর হয়েছে জলদূষণ। জলদূষণের প্রধান উৎসগুলিও মানব সমাজ দ্বারা পরিচালিত। কৃষিজ সার, শিল্পজাত বর্জ্য ও নর্দমা থেকে নিষ্কাশিত পদার্থ এই দূষণের মূল উৎস।
জলদূষণের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন রোগ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্ল্যাকফুট ডিজিস। এটি জলে আর্সেনিকের উপস্থিতিতে হয়ে থাকে। ব্ল্যাকফুট ডিজিসে প্রথমত শরীরের চামড়ায় বাদামী ছোপ পড়ে। পরে আস্তে আস্তে হাত ও পায়ের পাতা পুরু হয়ে যায়। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় বমি, ডায়রিয়া ও পাকতন্ত্রের অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হয়। তাই আর্সেনিককে চলতি কথায় “সেঁকো বিষ”-ও বলা হয়ে থাকে। ভৌমজলে আর্সেনিক সাধারণত আর্সোনেট ও আর্সোনাইট হিসাবে উপস্থিত থাকে। ভারতীয় গলীয় জলের মানদণ্ড অনুযায়ী, আর্সেনিকের উর্ধ্বসীমা প্রতি লিটারে ০.০৫ মিলিগ্রাম।
পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা সহ ৯টি জেলার ৮৫টি ব্লকের ৩২০০টিগ্রাম বর্তমানে আর্সেনিক প্রভাবিত অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত। যা এই রাজ্যের মোট আয়তনের ৩৮,৮৬৫ বর্গকিলোমিটার। এছাড়াও বীরভূম জেলার নলহাটির বাউটিয়া, ভবানন্দপুর, নসিপুর ও রামপুরহাটের গুরুচন্দ্রপুর ও কবিচন্দ্রপুর সহ বেশ কিছু অঞ্চলেরপানীয় জলে মাত্রাতিরিক্ত ফ্লুরাইড যৌগের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে। এই ফ্লুরাইডও জলকে দূষিত করে এবং মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করে।
জল সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার বিভিন্ন সময়ে একাধিক প্রকল্প চালু করেছে। ভারত সরকার জলদূষণ প্রতিহত করার জন্য ১৯৭৪ ও ১৯৭৭ সালে জলদূষণ নিবারণ ও নিয়ন্ত্রণ আইন লাঘু করেছিল। জল সংরক্ষণকে প্রাধান্য দিতে ১৯৮৭, ২০০২ ও ২০১২ সালে গ্রহণ করেছিল জাতীয় জলনীতি। তবে এগুলি খুব যে সফল হয়েছিল, তা বলা যায় না।
তবে কিভাবে এই জলদূষণ থেকে মুক্তি মিলবে? বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, মানবসভ্যতাকে এই জলদূষণের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে সর্বপ্রথম সঠিক পদ্ধতিতে জলকে সংরক্ষণ করতে হবে। জলদূষণের প্রতিকার ও জল সংরক্ষণ বিষয়গুলিকে সরকার অপেক্ষা সাধারণ মানুষকেই গণপ্রতিরোধ ও গণসচেতনতা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে জলের যথাযথ পরিচালন ব্যবস্থাপনাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কোন কোন ফসল কোন অঞ্চলে উৎপন্ন করা হবে বা প্রয়োজনীয় জলের সীমিত বন্টনের ওপর নজর দিতে হবে। আবার কোন ধরণেরশিল্প বা কারখানা কোন এলাকায় গড়ে তুললে জলের সমস্যা লাঘব হবে সেই দিকেও দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে সাধারণ মানুষকেই। এতে একদিনে যেমন জলদূষণ কমানো যাবে, ওপর দিকে জল সংরক্ষণও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ ২২ মার্চকে “আন্তর্জাতিক জল দিবস” হিসাবে ঘোষণা করেছে। তখন থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশে এই দিনে “বিশ্ব জল দিবস” পালন হয়ে আসছে। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হল জলশক্তির উৎস ও জল সংরক্ষণের গুরুত্বকে তুলে ধরা।
২০২০ সাল অর্থাৎ এই বছরের জল দিবসের বিশেষ ভাবনা “জল ও জলবায়ু পরিবর্তন”। যা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ হতে চলেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বছরের এই একটি দিন জল দিবস পালন করে সবাইকে সচেতন করা বেশ কঠিন। তাই প্রতিটা দিনই জল সংরক্ষণ ও জলের অপচয় রোধ করার দিকে মানব সমাজকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে যুক্ত কৃষক ও শ্রমিকদের তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে জল সংরক্ষণ বা তারপুনঃব্যবহারের উপায় শিখতে হবে। বাড়িতে কীভাবে সহজেই বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা যায় সে সম্পর্কেও মানুষকে অবগত হতে হবে। তাহলেই বিশ্ব জুড়ে জলের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সমতা বজায় থাকবে।
- All Rights Reserved
Advertisement