১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল পরাধীন ভারতের প্রথম লড়াই

Advertisement
sidu kanhu painting

কানন হাঁসদা : ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা আছে ১৮৫৫ সালের “সাঁওতাল বিদ্রোহ”-এর কথা যা ছিল স্বাধীনতার নবজাগরণের বা গণজাগরণের প্রথম লড়াই এই বিদ্রোহকে সাঁওতালী ভাষায় ‘হুল’ নামে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ভারত তথা বিদেশেও ১৮৫৫ সালের বিদ্রোহের কথা নতুন করে মানুষের সামনে উপস্থাপিত করা হচ্ছে। নানান অপবাদ, অপব্যাখ্যাকে দূরে সরিয়ে ইতিহাস তার আসল তথ্য অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষমও হয়েছে
     ভারতবর্ষের আদিম জনগোষ্ঠী আদিবাসী তথা সাঁওতাল সম্প্রদায় বরাবরই সহজ, সরল, নিরীহ, শান্তিপ্রিয়, সত্যনিষ্ঠ প্রকৃতিরযা যে কোনও সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত সম্মানের। আর এই সম্প্রদায়কেই সে সময়ে জোতদার, মহাজন আর ইংরেজরা শোষণ, শাসন, লুণ্ঠন এবং অত্যাচারে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। এই অত্যাচার আর বঞ্চনা থেকে জাতি-সম্প্রদায়কে বাঁচানোর জন্যে যে সংগ্রাম হয়েছিল ইতিহাসে সেটাই “অমর সাঁওতাল বিদ্রোহ” নামে পরিচিত
     মানুষের মেহনতের ফসল যখন তার ভোগ করার অধিকার থাকে না, মেহনতের মূল্য পায় না, নিজের এলাকার বন-জঙ্গলের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয় – এ আবার কেমন মুলুক? সেই সাথে একই ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে জমিদার, মহাজন, ইংরেজরা এই সম্প্রদায়কে ভোগ করেছে বছরের পর বছর। নানান কৌশলে খাজনা আদায় করেছে, ঋণে বাড়িয়ে দিয়েছে নানান অসঙ্গতিতাছাড়া গরীব-দুঃস্থ আদিবাসীকে ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণের জালে ফাঁসিয়ে তা বংশ পরম্পরায় শোধ করাতে বাধ্য করেছে বারবারতাই অভাবের তাড়নায় ঋণ গ্রহণ করলেও শোধ করতে না পেরে আদিবাসীরা একে একে হারাতে থাকে নিজের সম্পত্তি, নিজের পরিবারকে।
     এছাড়াও নিরাপত্তায় নিযুক্ত ইংরেজ পুলিশদের সীমাহীন দুর্নীতি ও অত্যাচার লক্ষ করা গিয়েছে সেসময়েএমনকি আদালতও তাঁদেরকে কোনও দিন সুবিচার দেয়নি। প্রতিনিয়ত শোষণ, অত্যাচার, উৎপীড়নের চাপে ধীরে ধীরে মরিয়া হয়ে উঠেছিল এই সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। নিজেদের আত্মরক্ষার পথকে তারা সংগঠিত করে শেষ পর্যন্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয় বিদ্রোহের
     ১৮৫৫ সালের অভ্যুত্থান কেবলমাত্র উপজাতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, উপজাতীয় নয় এমন সম্প্রদায়ও এই বিদ্রোহে সামিল হয়ে সহযোগিতা করেছিল সে সময়ে সাধারণ মেহনতি মানুষও বুঝতে পেরেছিল ‘শোষণের কোনও জাত হয় নাশোষকদের উৎখাত তাই করতেই হবে’
     শোষণ, পীড়ন, অত্যাচারের কথা সেই সময় নানান পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, সেসময়ে সাঁওতালদের মধ্যে ক্রমশ প্রতিহিংসার মনোভাব গড়ে উঠতে থাকে। ফলে মহাজনদের বাড়িতে ডাকাতি বা চুরি হতে থাকে। কেবলমাত্র সুদখোর মহাজনদের বাড়িতেই এমনটি হতে লাগলোুলিশ তাঁদেরকে ধরে চরম শাস্তি দিলোদিঘি থানার দারোগা মহেশলাল দত্ত ‘গোক্কো’ নামের এক ধনী সাঁওতালকে ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রেপ্তার করে নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলেনমহেশ দারোগার এই অত্যাচারের কথা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে জনরোষের আগুন আরও বাড়িয়ে তোলে প্রতিহিংসার জন্য বীরসিং মাঝি নামে এক সাঁওতাল ডাকাতদল গঠন করেন।
     ১৮৫৫ সালে ৩০ জুন সিধু-কানহু, চাঁদ, ভৈরবের নেতৃত্বে তখনকার বিহার রাজ্যের ভগনাডিহির মাঠে দশ হাজার মানুষ একত্রিত হয়েছিলদলে দলে হাজারীবাগ, ছোটনাগপুর, জামতাড়া, সিংভূম, গোড্ডা, কুণ্ডহিত, দেওঘর থেকে তামাম আদিবাসী সম্প্রদায় এই সমাবেশে সামিল হয়েছিলসমাবেশে একটি চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তাঁদের বক্তব্যে উঠে আসে, এইভাবে প্রতিনিয়ত অত্যাচার চলতে থাকলে তাঁদেরকে নিজেদের এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে। তাঁদের জীবনে নেমে আসবে চরম সঙ্কট। যে করেই হোক অত্যাচারী সুদখোর, মহাজন, জোতদার, জমিদার, ইংরেজদের উৎখাত করতেই হবে। সেই সাথে ঘোষণা করা হয়, একে একে কিতা, মলু, ইংরেজ সরকার কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট, বীরভূমের কালেক্টর ম্যাজিস্ট্রেট, দিঘি থানা, লিটিপাড়া আক্রমণ করা হবে।
     ধীরে ধীরে এই ‘বিদ্রোহ’ আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে থাকে। ফলে দমন করার জন্য মেজর বারোজ বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিদ্রোহীরা পাকুড় থানা সহ রাজবাড়ি দখল ও লুণ্ঠন করতে থাকে। সেই সাথে কয়েকজন মারাও যানভাগলপুর কমিশনারের নির্দেশে ছোটনাগপুর, সিংভূম, হাজারিবাগ থেকে বিপুল পরিমাণে সৈন্য এনে বিদ্রোহীদের আটকানো হয়। কিন্তু এই যুদ্ধে মেজর বারোজ পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন। চারিদিকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে থাকে। বীরভূমের নলহাটি, রামপুরহাট, লাঙ্গুলিয়া, গুর্জর, সিউড়ি, নারাণপুরেও সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
     সেদিন ইংরেজ বাহিনী নানান কৌশলে এই বিদ্রোহ দমন করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সফলও হয়েছিল। সাঁওতালদের চিরাচরিত তির-ধনুক, লাঠি-বল্লভ ইংরেজবাহিনীর বন্দুক-কামানের সামনে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি ঠিকই, তবে সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যেও তাঁদের মনোবলে এতটুকু ভাঁটা পড়েনি। তাঁরা হেরে গিয়েও পরাজয়ের কথা স্বীকার করেনি। যুদ্ধক্ষেত্রে চাঁদ, ভৈরব প্রাণ বিসর্জন দেন শেষে গ্রেপ্তার করা হয় সিধু-কানহুকে। পরে তাঁদের জনসমক্ষে ফাঁসি দেওয়া হয়।
     ১৮৫৫ সালের ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ তেমনভাবে সফল হয়নি, কিন্তু এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারের ভিত সাময়িকভাবে কাঁপিয়ে দিতে পেরেছিলতাই নিঃসন্দেহে বলা যায় পরাধীন ভারতের এটাই ছিল প্রথম স্বাধীনতার লড়াই।
Advertisement
Previous articleপটলপুর ক্রমশ পরিণত হচ্ছে বীরভূমের একটি লুপ্তপ্রায় গ্রামে
Next articleসুরের ভুবনে নজরুল যেন জাদুকর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here