Advertisement
দেবকুমার দত্ত : আজ স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৮তম জন্মদিন। অন্য কথায়, ১৫৭তম জন্মজয়ন্তী। সেদিন সোমবার। ২৯শে পৌষ ১২৬৯। ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩। মকরসংক্রান্তির পুণ্যস্নানের মাহেন্দ্রক্ষণ। চারপাশে মঙ্গলশঙ্খের ধ্বনি। সূর্য উঠতে তখনও ৬ মিনিট বাকি। তখন ভোর ৬টা ৩৩ মিনিট ৩৩ সেকেন্ড। উত্তর কলকাতার শিমুলিয়া পল্লির দত্ত বংশে জন্ম নিল এক শিশু। বাবা বিশ্বনাথ দত্ত। মা ভুবনেশ্বরী দেবী। ধনসম্পদ, দানধ্যান, পাণ্ডিত্য, আভিজাত্য ও সুরুচির জন্য এই দত্ত পরিবার সুবিখ্যাত।
বারানসীর শ্রীশ্রীবিশ্বেশ্বরের কাছে ভুবনেশ্বরী দেবী মানত করেছিলেন। পুত্র সন্তান কামনা করেছিলেন। তাই ভুবনেশ্বরী নবজাতকের নাম রাখলেন বীরেশ্বর। সন্ন্যাসী ঠাকুরদার নামের অনুসরণে কেউ নাম রাখতে চাইলেন দুর্গাচরণ। সামাজিক নাম নরেন্দ্রনাথ। বাড়িতে সবার কাছে আদরের ডাকনাম বিলে। কেউ ডাকতেন নরেন। ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ দেব ডাকতেন লরেন। পরবর্তীকালে ইনিই বিবিদিষানন্দ ও সবশেষে বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হন। এটুকুই তাঁর বিভিন্ন পর্বে নাম-পরিচয়।
বিলে’র খুব বিটকেলে বুদ্ধি। অত্যন্ত দুরন্ত। হাসি-মজা-কৌতুক তাঁর খুব প্রিয়। মায়ের কাছে রামায়ণ ও মহাভারতের গল্প শুনতেন। বছর তিনেক বয়সে ঝগড়াঝাটি, মারামারি ও দস্যিপনা করে সময় কাটে। তখন থেকেই সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি অগাধ টান। প্রাণভরা শ্রদ্ধা-ভক্তি। দুষ্টুমি আর দুষ্টুমি। মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমি। বিব্রত ও বিরক্ত মা। ভুবনেশ্বরী মাঝে মধ্যে বলতেন, ‘অনেক মাথা খুঁড়ে শিবের কাছে একটা ছেলে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি পাঠিয়েছেন একটা ভূত!’ নরেন রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। বাড়ির জিনিসপত্র ভেঙেচুরে একসার।
তবে দস্যিপনা কমাতে ভুবনেশ্বরী একটি মোক্ষম দাওয়াই প্রয়োগ করতেন। প্রথম তাঁকে বলতেন, ‘শিব তোকে কৈলাসে যেতে দেবে না।’ বিলে ঠাণ্ডা হয়ে যেত। কখনও কখনও মা নরেনের মাথায় ‘শিব শিব’ বলে জল ঢালতেন। ফল ভালোই পেতেন মা। নরেন একদম চুপচাপ। ছেলেবেলাতেই নরেনের হৃদয় ছিল দয়া-দাক্ষিণ্যে ভরপুর। নিজের পরনের ধুতিই তিনি এক সন্ন্যাসীকে খুলে দিয়েছিলেন।
একদিন ব্যারিস্টার বাবা বিশ্বনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘নরেন তুই বড় হলে কী হবি বল দিকি?’ তৎক্ষণাৎ নরেনের জবাব, ‘ঘোড়ার সহিস কি কোচোয়ান হব।’ কোচোয়ানের অশ্ব-চালনা, জামাকাপড়, জরির পাগড়ি নরেনকে খুব আকর্ষণ করত। জীবজন্তুর প্রতি নরেনের ছিল খুব দরদ। অগাধ সহানুভূতি। ছাগল, বানর, কাকাতুয়া, ময়ূর, পায়রা ছিল তাঁর খেলার সাথী। তাঁর পোষা ছাগলের নাম মটরু। একটি ছাগীর নাম রেখেছিলেন হংসী। এই মটরু হঠাৎ মারা গেলে নরেন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।
পাঁচ বছর বয়সে নরেনের হাতেখড়ি হল। বংশের পুরোহিত মাটিতে ক খ লিখে নরেনের পড়াশোনা শুরু করলেন। বগলে মাদুর, পরনে কোরা ধুতি আর খাগের কলম নিয়ে নরেন যেতেন পাঠশালায় পড়তে। শেষমেশ বাড়ির ঠাকুরদালানে পাঠশালা খোলা হয়। প্রাথমিক শিক্ষার পর নরেন্দ্রনাথ ভর্তি হলেন বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউশন-এ। টিফিন পিরিয়ডে কাবাডি খেলতেন নরেন। বাড়িতে সকাল-সন্ধ্যায় খুব অল্প পড়তেন। তবে বার্ষিক পরীক্ষার ফল অসামান্য। ব্যাটবল বা ক্রিকেট খেলায় নরেনের আগ্রহ ছিল প্রবল। বন্ধুদের ঝগড়া নরেন মিটিয়ে দিতেন।
বিশ্বনাথ দত্তের মামলা-মোকদ্দমার ব্যাপারে বিভিন্ন ধর্ম-মতের লোক আসত। ওই সব মক্কেল নানা রকম বর্ণের ও ধর্মের। নরেন এই জাতপাত পছন্দ করতেন না। তিনি সুযোগ পেলেই মক্কেলদের জন্য রাখা হুঁকো টানতেন। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ সব কি করছিস নরেন?’ ছেলের জবাব, ‘দেখছি কেমন করে জাত যায়।’
এই হল সংক্ষেপে নরেন্দ্রনাথের ছেলেবেলা।
Advertisement