‘স্বর্গ বাতি’ বাঙালির লৌকিক ঐতিহ্যের একটি লুপ্তপ্রায় প্রথা

Advertisement
পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়াও ‘স্বর্গ বাতি’ দেওয়ার পিছনে নানা লোকবিশ্বাস বর্তমান। সাধারণত আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি থেকে কার্তিক মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত সন্ধ্যার সময় ‘স্বর্গ বাতি’ উত্তোলনের প্রথা লক্ষ্য করা যায়। এই বাতি তোলার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম লৌকিক মন্ত্র প্রচলিত আছে। এরকমই একটি মন্ত্র, “দামোদর রায় নভসি তুলায়াবে লেলয়া সহ প্রদীপন্তে প্রযচ্ছামি নমঃ অনন্তায় বেধসে।” অর্থাৎ কিনা লক্ষ্মী-নারায়ণ-কে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রণাম করা হচ্ছে।

‘স্বর্গ বাতি’ বাঙালির লৌকিক ঐতিহ্যের একটি লুপ্তপ্রায় প্রথা
Image by S. Hermann & F. Richter from Pixabay

সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : ছোটবেলায় দাদুকে দেখতাম কার্তিক মাসের প্রতি সন্ধ্যায় একটি বাঁশের ডগায় বাতি জ্বালতে। বাতি জ্বালানোর জন্য একটি লম্বা বাঁশের মাথায় একটি ছোট্ট কপিকল লাগানো থাকত। তার সাথে সংলগ্ন দড়ির অপর প্রান্তে ফানুশের মতো দেখতে একটি বাঁশের তৈরি কাঠামো ছিল। তার চারদিকে লাগানো থাকত রং-বেরঙের কাগজ। সেই কাঠামোর মধ্যে প্রদীপ জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে দড়ি টেনে আলোটিকে বাঁশের ডগায় পৌঁছে দেওয়া হতো।

আলো জালানো হলে দাদু আমাদের সেই দড়ি টানার জন্য উৎসাহিত করতেন। আমরা গুটিকয় নাতি অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে ‘স্বর্গ বাতি’ জ্বালানোর জন্য দাদুকে সাহায্য করতাম। অনেক সময় অতি উৎসাহে দ্রুত ট্রেনে ফেলতাম। সাবধানতার জন্য দাদু তখন রশির রাস নিজের হাতে তুলে নিতেন।

একবার প্রশ্ন করেছিলাম, “তুমি কেন প্রতিদিন এই বাতিটা আকাশের ঝোলাও?” দাদু উত্তর দিয়েছিলেন, “স্বর্গে আমাদের যেসব পূর্বপুরুষেরা রয়েছেন, তাদের প্রণাম জানানোর জন্যই এই বাতি জ্বালানো হয়। এভাবে বাতি জালানো হলে তাঁরা বুঝতে পারবেন আমরা তাঁদের ভুলে যাইনি এবং তাঁরা স্বর্গ থেকে আমাদের বাড়িটাকে চিহ্নিত করতে পারবেন ও খুশি হয়ে আমাদের আশীর্বাদ করবেন।” আজ বুঝতে পারি ধর্মভীরু দাদুর সেই সহজ-সরল কথাটি মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। সোশিয়লজির ভাষায় যাকে বলে প্রাইমারি সোশিয়ালাইযেশন।

কতকাল আগে দাদু নিজেই স্বর্গারোহণ করেছেন। আজ আর কেউ বাতি জ্বালায় না। বাংলা থেকে একরকম উঠেই গেছে এই প্রাচীন শ্রদ্ধা জানানোর প্রথা। তবু এখনও কেউ কেউ বাড়ির ছাদে ইলেকট্রিকের ছোট আলো জ্বালিয়ে রাখেন সেই প্রথার সূত্র ধরে। প্রসঙ্গত জানাই এই প্রথার থেকেই জন্ম হয়েছিল একটি প্রাচীন বাংলা প্রবাদের, “বংশে বাতি দেওয়া”! আগেকার দিনে বংশ লোপ পেলে বলা হত, ‘ওদের বংশে বাতি দেওয়ার কেউ নেই’। অথবা অনেক সময় গ্রামাঞ্চলে অভিশাপ দেওয়ার জন্য লোকে বলত, ‘অভিশাপ দিচ্ছি, তোর বংশে বাতি দেওয়ার কেউ থাকবেনা।’ অর্থাৎ কিনা নির্বংশ হলে আর কেউ পূর্ব পুরুষদের জন্য বাতি জ্বালাবে না।

বিষয়টি অবশ্যই লৌকিক এবং এই বিজ্ঞানের যুগে অবশ্যই তার কোনও ভিত্তি হয়তো নেই। কিন্তু একটা কথা অস্বীকার করা যাবে না, বিষয়টির সঙ্গে নিজের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর যে অপূর্ব ঐতিহ্য প্রচলিত ছিল তার কোনও তুলনা হয় না। পূর্বপুরুষদের জন্য আলো জ্বালানোর প্রথা ইসলাম এবং খ্রিস্টধর্ম সহ প্রায় সমস্ত প্রাচীন ধর্মমতেই প্রচলিত আছে। বর্তমানে এই বিজ্ঞানের যুগে ঘোরতর নাস্তিকেরাও মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকেন। এর পিছনে সেই প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রভাব বর্তমান।

পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়াও ‘স্বর্গ বাতি’ দেওয়ার পিছনে নানা লোকবিশ্বাস বর্তমান। সাধারণত আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি থেকে কার্তিক মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত সন্ধ্যার সময় ‘স্বর্গ বাতি’ উত্তোলনের প্রথা লক্ষ্য করা যায়। এই বাতি তোলার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম লৌকিক মন্ত্র প্রচলিত আছে। এরকমই একটি মন্ত্র, “দামোদর রায় নভসি তুলায়াবে লেলয়া সহ প্রদীপন্তে প্রযচ্ছামি নমঃ অনন্তায় বেধসে।” অর্থাৎ কিনা লক্ষ্মী-নারায়ণ-কে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রণাম করা হচ্ছে। যেহেতু কার্তিক মাসে ধান কাটা হয় এবং ধান হল লক্ষ্মীর প্রতীক। তাই গ্রামাঞ্চলের গৃহস্থরা প্রভূত লক্ষ্মী লাভের আশায় এই বাতি জ্বালিয়ে লক্ষ্মী-নারায়ণ-কে প্রণাম জানান।

অপর একটি মত হলো, কার্তিক মাস থেকে সূর্যের দক্ষিণায়ণ শুরু হয়। ফলে দিন ছোট ও রাত বড় হয়। তাই গ্রামাঞ্চলে আলোর জন্য গৃহস্থরা এই বাতি প্রজ্জ্বলন করে থাকেন। আরেকটি অভিমতও প্রচলিত আছে, ফসল যাতে নির্বিঘ্নে গোলাজাত করা যায় তার জন্য দেবসেনাপতি কার্তিককে শ্রদ্ধা জানানো হয় এই বাতি জ্বালানোর মধ্য দিয়ে। এই ব্যাখ্যাটি সম্ভবত বাংলায় বর্গী হাঙ্গামার সময় সংযুক্ত হয়েছে।

‘স্বর্গ বাতি’-র ঐতিহ্যের পিছনে যে কারণই থাকুক না কেন, এর আধ্যাত্বিক সৌন্দর্যকে কোনওভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। অগণিত তারার মধ্যে তারা হয়ে থাকা পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে আলোর মাধ্যমে সামান্য শ্রদ্ধা নিবেদনের লৌকিক পরম্পরার পিছনে যে মানসিকতা তা অবশ্যই অনবদ্য।

Advertisement
Previous articleকরোনা আবহে এই বছর বন্ধ থাকছে শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা
Next articleঅবাঙালিদের সঙ্গে এখন বাঙালিরাও ধনতেরাস-কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here