Advertisement
ধ্রুব পাল : বড়দিন প্রায় চলেই এল। ইতিমধ্যেই বাজারের দোকানগুলিতে হাজির হয়েছে ছোটো-বড়ো নানান আকারের ক্রিসমাস ট্রি। সেই ছোট্ট কৃত্রিম গাছগুলিকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন সাজে। সাজানো হয় আপেল, পাখি, মোমবাতি, ঘুঘু, মাছ, ফুল, ফল, স্বর্গদূত আর রঙ–বেরঙের কাগজ ও বাতি দিয়ে।
প্রকৃতপক্ষে ক্রিসমাস ট্রি হিসাবে যে গাছটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়, সেটি হল একটি ফার গাছ।যা মূলত দেবদারু জাতীয় গাছ। এছাড়াও ঝাউ জাতীয় গাছও ক্রিসমাস ট্রি হিসাবে ব্যবহার করা যায়। ক্রিসমাস ট্রির ওপরে একটি তারা বা স্বর্গদূত বসানো থাকে। এই স্বর্গদূতটি বেথেলহেমে জন্ম নেওয়া যিশুখ্রিস্টের প্রতীক।
বড়দিনে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো এবং উপহার দেওয়ার শুরু কীভাবে হয়েছিল তার সম্পূর্ণ ও সঠিক ব্যাখ্যা আজও পাওয়া যায়নি। এ নিয়ে প্রচলিত আছে বেশ কিছু গল্প –
এমন একটি গল্প হল, রোমের এক গরীব কাঠুরিয়ার ঘরে একদিন এক শীতার্ত শিশু এসে হাজির হল। কাঠুরিয়া দম্পতি ছিল প্রচণ্ড রকম যিশুভক্ত। তারা শিশুটিকে আদর করে খাওয়াল, নরম বিছানায় শুতে দিল। সকালে ওই শিশু দেবদূতের রূপ ধরে বলল, আমিই যিশু। তাকে আদর-আপ্যায়ন করার জন্য কাঠুরিয়া দম্পতিকে শিশুটি একটি গাছের ডাল উপহার দিল এবং তা মাটিতে পুঁতে রাখতে বলল। তারপর ক্রিসমাসের দিন দেখা গেল ডালটি সোনালী আপেলে ভরে গিয়েছে। তখন তারা ওই গাছটির নাম দিল ক্রিসমাস ট্রি।
আরেকটি গল্প অনুযায়ী, একদিন এক গরীব শিশু কিছু পাইন গাছের চারার বিনিময়ে পয়সা দেওয়ার অনুরোধ করল এক গির্জার মালিকে। মালি তার থেকে গাছগুলো নিয়ে গির্জার পাশে পুঁতে রাখল। ক্রিসমাসের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখল, গাছগুলোলম্বায় গির্জার মাথা প্রায় ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং সেগুলো থেকে অজস্র তারার আলোঠিকরে পড়ছে। মালি তখন গাছগুলোর নাম দিল ক্রিসমাস ট্রি।
তবে প্রচলিত গল্প ছাড়াও কিছু ঘটনা এই ক্রিসমাস ট্রির জন্ম দিতে পারে বলে অনেকের অনুমান। এই রকমই একটি মতঅনুসারে, ক্রিসমাস ট্রির ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে জার্মানির গেইসমার শহরের এক সাধু বনিফেস এর সঙ্গে। সেইন্ট বনিফেস (৬৭২-৭৫৪ খৃঃ)নামের ওই সাধু একটি প্রাচীন ওক গাছের মূলে একটি দেবদারু জাতীয় ফার গাছের বেড়ে ওঠা দেখতে পেয়েছিল। পরে সে ওই গাছটিকে যিশুখ্রিস্টের প্রতি বিশ্বাসের চিহ্ন হিসাবেপ্রতিষ্ঠিত করেছিল।
তবে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা যায়, বড়দিন উদযাপনে ক্রিসমাস ট্রির প্রচলন আদি খ্রিষ্টানদের থেকে হয়নি। আদি রোমানরা গাছের উপাসনা করত, তারাই পরে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে এই ঐতিহ্য ও আচার পালন বড়দিনের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। প্রাচীন সভ্যতায় বার্ষিক উৎসবে গাছ সাজানোর জন্য একটা আলাদা রীতি চালু ছিল। মিসরীয়রা শীতকালীন উৎসবে তালজাতীয় গাছকে সাজাত। তারা মনে করত, সুচালো পাতার এই গাছ বসন্তের সজীবতা নিয়ে আসবে। মিসরীয়দের মতো রোমানরাও গাছ সাজাত।
ইউরোপের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর শুরুটা। ১৫ শতকে লন্ডনের প্রতিটি বাড়ি ও গির্জা আইভিলতা দিয়ে সাজানো হতো। তাদের বিশ্বাস ছিল, আইভিলতার পাতা পৃথিবীতে যিশুর আগমনের প্রতীক।
আধুনিক ক্রিসমাস ট্রি সাজানোরও প্রথা চালু হয় জার্মানিতে। ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী জার্মান রাজপুত্র অ্যালবার্ট প্রথম ক্রিসমাস ট্রি সাজায়। ১৮৪১ সালের ক্রিসমাসে উইন্ডসর প্রাসাদে অনেকটা পারিবারিকভাবেই ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়। আর এভাবেই নিজের দেশের রীতি ইংল্যান্ডে চালু করে অ্যালবার্ট। সে ক্রিসমাস ট্রি বিভিন্ন স্কুল ও সামরিক ঘাটিতেও পাঠিয়ে দেয়।
জার্মানরা ক্রিসমাস ট্রি সাজাত ফল, চকলেট, মিষ্টি জাতীয় খাবার, রঙিন কাগজ দিয়ে। মূলত এই রীতিতে আধুনিক ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে যে প্রথায় ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয় সেটি অবশ্য বেশি দিনের পুরোনো নয়। এই প্রথাটির প্রচলন করেছিল মার্টিন লুথার। স্বর্গোদ্যানের ট্রি অফ লাইফ এর চিহ্ন হিসেবে এই প্রথার প্রচলন করে সে। ক্রিসমাস ট্রির সঙ্গে মোমবাতি জ্বালানোর প্রথা শুরু হয়েছিল ১৮ দশকের শেষদিকে।
জার্মানির রাইনল্যান্ডের প্রটেস্টানদের কাছ থেকে এই প্রথার শুরু হলেও রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মধ্যেও পরে এটি ছড়িয়ে পড়ে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস এডিসনের এক সহকর্মী এডওয়ার্ড জনসন ১৮৮২ সালে প্রথমবারের মতো বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে ক্রিসমাস ট্রি সাজায়। সে তার ক্রিসমাস ট্রিটি সাজাতে ছোট ছোট প্রায় ৮০টি বাল্ব ব্যবহার করেছিল।
ঐতিহ্য অনুসারে, ২৪ ডিসেম্বর ক্রিসমাস সন্ধ্যার আগে ট্রি সাজানো যায় না। আর এটি সরিয়ে ফেলা হয় ১২তম রাতে অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি।এছাড়া অনেকেই মনে করেন, এই নিয়ম না মানা হলে অমঙ্গল হতে পারে। তবে প্রথাগতভাবে না হলেও এখন ক্রিসমাস ট্রি বড়দিনের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সাজানো হয়। জার্মানিতে এটি অবশ্য ঐতিহ্য অনুসারে এখনও ২৪ ডিসেম্বরেই সাজানো হয় এবং ৭ জানুয়ারি খুলে ফেলা হয়। ক্যাথলিকদের রীতিতে এটি জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত সাজিয়ে রাখা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় এটি ডিসেম্বরের শুরুতে সাজিয়ে গ্রীষ্মের ছুটি পর্যন্ত রাখা হয়।
Advertisement