Advertisement
দীর্ঘ ৩-৪ মাস বন্ধ রয়েছে সোনাঝুরির হাট। তাই এই হাটের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা হস্তশিল্পীরা বেশ দুরাবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। শিল্পীরা জানাচ্ছেন, করোনা পরিস্থিতিতে তাঁদের তৈরি বিভিন্ন সৌখিন দ্রব্যের কদর কমেছে। বেচাকেনা একেবারেই নেই। সোনাঝুরির হাট কবে চালু হবে, তাও এখন প্রায় অনিশ্চিত। – ছবি : ফাইল চিত্র
|
মৌমিতা দাস : শান্তিনিকেতনের দৌলতে বীরভূমের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে বিদেশে। প্রতি বছর অসংখ্য বিদেশী পর্যটক এই শান্তিনিকেতনের টানেই বীরভূমের রাঙ্গামাটির ধুলোয় তাঁদের পা রাঙ্গাতে ছুটে আসেন। শান্তিনিকেতনে পর্যটকদের আরও আকর্ষণ বাড়িয়েছে খোয়াই বা সোনাঝুরির হাট। সপ্তাহের প্রত্যেক শনিবারই সোনাঝুরির বিকালের সোনালী ছায়ায় এই হাটে পসরা সাজিয়ে বসেন রাঙ্গামাটির হস্তশিল্পীরা তাঁদের নিজেদের তৈরি বিভিন্ন ধরণের শিল্প সামগ্রী নিয়ে। জনমুখে এই ‘হাট’ এখন পরিচিতি পেয়েছে ‘শনিবারের হাট’ বা ‘অন্যবনের হাট’ নামে। এছাড়াও আকর্ষণ বাড়িয়ে এখানে প্রতি হাটেই দেখতে পাওয়া যায় সাঁওতালি রমণীদের নিজস্ব ভঙ্গিতে নৃত্য আর বাউল শিল্পীদের মনভোলানো বাউল গান।
দীর্ঘদিন ধরেই বোলপুর ও শান্তিনিকেতন উপকন্ঠের এই সোনাঝুরির হাট গ্রামীণ লোকশিল্পীদের অন্যতম জীবন ও জীবিকার মাধ্যম হিসাবে রয়ে গিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা সংক্রমণ। কারণ করোনা সংক্রমণের এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক নির্দেশে সোনাঝুরির এই হাট এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। বন্ধ রয়েছে প্রায় ৩-৪ মাস ধরে। পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় এই হাট আবার কবে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হবে, তার সঠিক দিনক্ষণ এখনও জানা যাচ্ছে না। ফলে দারুণ চিন্তায় রয়েছেন এই হাটের উপর নির্ভর করে থাকা গ্রামীণ লোকশিল্পীরা।
সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন সেই সব হস্তশিল্পী, যাঁরা সম্পূর্ণভাবেই নির্ভর করে রয়েছেন এই হাটের উপর। আবার কবে এই হাট উন্মুক্ত হবে, কবে আবার লোকসমাগম হবে, বিদেশী পর্যটকের ভিড় বাড়বে তা এখন প্রায়ই অনিশ্চিত। কিছুদিন আগে অবশ্য লকডাউন কিছুটা শিথিল করেছিল প্রশাসন। শিল্পীরা ভেবেছিলেন, এবার হয়তো সোনাঝুরির হাট আবার আগের মতো উন্মুক্ত হবে। কিন্তু হল কোথায়? ‘অধিক লোকসমাগম করোনা ছড়াতে পারে’, এই যুক্তিতে বন্ধই থেকে গেল এই হাট।
লকডাউন শিথিলের সময় কিছু শিল্পী অবশ্য পেটের দায়ে তাঁদের হস্তশিল্প সামগ্রী নিয়ে বেশ কয়েকদিন সোনাঝুরির হাটের প্রান্তরে বসেছিলেন বিক্রির আসায়। কিন্তু ক্রেতা মেলেনি তাঁদের। করোনা সংক্রমণের এই সময়ে স্থানীয় বা বিদেশী পর্যটকদের কাউকেই আসতে দেখা যায়নি এই হাটে। ফলে দিনের শেষে প্রায় খালি হাতেই ঘরে ফিরতে হয়েছে ওই শিল্পীদের। হস্তশিল্পীদের কথায়, লকডাউনের জন্য মানুষের মধ্যে সৌখিন শিল্প সামগ্রী কেনার আগ্রহ একেবারেই কমে গিয়েছে। যতদিন না করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, ততদিন হয়তো এই হাট বন্ধই থাকবে।
সোনাঝুরির এই হাট এখন বন্ধ থাকায় চরম দুরাবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন ডোকরা থেকে কাঁথাস্টিচ, চর্ম, টেরাকোটা সহ আরও অন্যান্য শিল্পীরা। একইভাবে এই হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন এই হাটকে আঁকড়ে থাকা বাউল ও আদিবাসী লোকসংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত থাকা শিল্পীরাও।
শুধু সোনাঝুরির হাট নয়, শান্তিনিকেতন গুরুপল্লীর রাস্তার পাশে পসরা নিয়ে বসা হস্তশিল্পীদের দোকানগুলিও এখন বন্ধ। সাঁইথিয়ার বাঘডাঙা গ্রাম থেকে আসা প্রবীণ কাঠের চিরুনি শিল্পী সহদেব সিংহ জানালেন, ট্রেন-বাস চলাচল না করায় তাঁরা আর হাটে যেতে পারছেন না। আয় একপ্রকার প্রায় বন্ধ। খুব কষ্ট করে মানিয়ে নিতে হচ্ছে।
তবে এখনই হাল ছাড়তে চাইছেন না সোনাঝুরির ওই হস্তশিল্পীরা। তাঁরা অপেক্ষায় রয়েছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার দিকে তাকিয়ে। তাঁরা আশা করছেন, দ্রুত এই অবস্থার উন্নতি হবে। সবকিছু আবার আগের মতোই ঠিক হয়ে যাবে। আবার নতুন ছন্দে ফিরে আসবে সোনাঝুরির হাট। প্রাণ ফিরে পাবে গ্রামীণ লোকশিল্প ও লোকসংস্কৃতি চর্চা।
Advertisement