Advertisement
ধ্রুব পাল : সেদিনের আকাশ ছিল ঘন নীল। গাছগুলো ছিল আরও সবুজ। গ্রামের পথে পথে বসত নাম না জানা হরেক পাখির মেলা। সেদিনের সকালবেলার ঘুমও ভাঙাত এই সব হরেক পাখিরা। আজও ঘুম ভাঙে। তবে পাখিদের কাকলিতে নয়, মোটর-যান-কলকারখানার কর্কশ শব্দে। তাই নিজের অজান্তেই নিজের কাছে প্রশ্ন জাগে, সেই সব পাখিরা আজ কোথায় গেল? তারা কি হারিয়ে গেল কালের গরল স্রোতে? সত্যিই তাই। কেউ কেউ চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে। কেউ বা হারিয়ে যাওয়ার পথে।
![]() |
দোয়েল |
শীতের সকালে শিস বাজিয়ে লেজ দুলিয়ে ঝগড়া করত সাদা-কালোর দোয়েল জুটিরা। যাদের আবার ওপার বাংলার জাতীয় পাখির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এখন আর সেই ঝগড়ার শব্দ শোনা যায় না। এ যেন অলিখিত বিরতি। বিরতিই বটে। আগের মত সচরাচর এখন আর দোয়েল চোখে পড়ে না। হঠাৎ করেই তাদের সংখ্যা কমে গিয়েছে আমাদের গ্রাম-বাংলায়।
![]() |
হাড়গিলা |
বইয়ের পাতায় হাড়গিলার নাম শোনেনি এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অনেকে আবার সুযোগ পেলে অন্য কাউকে হাড়গিলার সাথে তুলনাও করে থাকে। কিন্তু হাড়গিলা দেখেছে, এমন মানুষও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর দেখবেই বা কেমন করে। তারা যে আজ বাংলার মাটিতে এক বিলুপ্ত প্রজাতির পাখি। তবে এরাই বছর ষাটেক আগে নির্বিচারে ঘুরে বেড়াত গ্রাম-বাংলার নদী, হ্রদ, ছোটো–বড় জলাধার, খাল, খোলা বন ও বাদাজমিতে। গোটা বিশ্বে এদের তিনটি প্রজাতি থাকলেও আমাদের বাংলায় দুটি প্রজাতি ছিল, বড় মদনটাক আর ছোটো মদনটাক। ছোটো মদনটাক এখন শুধু সুন্দরবনের নদীর ধারগুলিতেই দেখা যায়। কিন্তু বড় মদনটাক বা হাড়গিলাকে আর কোত্থাও দেখতে পাওয়া যায় না।
![]() |
শামুকখোল |
শামুকখোল হল সাদা চোখের এক বিশেষ প্রজাতির দলবদ্ধ জলচর পাখি। বাংলার খাল-বিল, ধানক্ষেত, নদীর ধারগুলিতে এক সময়ে নির্বিচারে ঘুরে বেড়াত তারা। এদের প্রধান খাদ্য ছিল শামুক, ঝিনুক, ব্যাঙ, কাঁকড়া প্রভৃতি। জলের মাত্রা ছাড়া দূষণের ফলে সেই সব খাদ্যেরা এখন আর তেমন জন্মাতে পারছে না। হয়তো সে কারণেই শামুকখোল-এর দল এই বাংলায় আজ বিলুপ্তপ্রায়।
গ্রামের কারও গরু বা ছাগলের মৃত্যু হলেভাগাড়ে ফেলে আসতে হত। পরক্ষণেই দেখা যেত সেই মৃত প্রাণীটিকে ঘিরে শকুন-এর দল একটা ছোটো খাটো মেলা বসিয়ে দিয়েছে। সেদিন এই সব শকুন-এর দল ছিল বলেই পরিবেশে মৃত প্রাণী থেকে তেমন দুর্গন্ধ বা রোগ ছড়াত না। গ্রামের শেষ প্রান্তে অবশ্য সেইভাগাড়গুলো আজও আছে। আজও ফেলা হয় মৃত গরু বা ছাগল। কিন্তু দু-এক দিন পরও সেগুলি তেমনই পড়ে থাকে। কেউ ছুঁয়েও দেখে না। পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়ায় আর সৃষ্টি হয় যত রোগের।
![]() |
শকুন |
আমাদের গ্রাম-বাংলায় এককালে জন্মানো সেই হারিয়ে যাওয়া শকুন-এর প্রজাতিও কিন্তু কম নয়। সারা বিশ্বে আঠারো প্রজাতির শকুন থাকলেও আমাদের দেশে ছিল মাত্র ছয় প্রজাতির– রাজ শকুন, গ্রীফন শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরুঠোঁট শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন। কিন্তু বর্তমানে এদের কাউকেই এখন আর দেখা যায় না। হারিয়ে গিয়েছে চিরদিনের জন্য।
এ রকমই শত শত প্রজাতির পাখিরা আজ কালক্রমে হারিয়ে যেতে বসেছে আমাদের গ্রাম-বাংলার পরিবেশ থেকে। চড়াই, বেনে বউ, হাঁড়িচাঁচি, ঝুঁটি শালিক, পেঁচা এদের মধ্যে অন্যতম। আর সেই সাথে ক্রমশ যাতায়াত কমিয়ে দিচ্ছে বিদেশী পরিযায়ী পাখিরাও।
এর কতকগুলি কারণও আছে।নির্বিচারে পাখি শিকার, পরিবেশের মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া দূষণ, জলাশয়ে কীটনাশকের প্রকোপ, অতিরিক্ত বৃক্ষচ্ছেদন, জলবায়ু পরিবর্তন, শহরাঞ্চলে রাতের চোখ ঝলসানো লাইটের ব্যবস্থা ইত্যাদি।
পৃথিবীটা শুধুমাত্র মানুষেরই আবাস্থল নয়, পশু-পাখিদেরও বাসস্থান। আমরা টিকিয়ে রাখলে তারা টিকে থাকবে। আর তারা টিকে থাকলেরক্ষা পাবে পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র। এখন বুঝতে হবে, পরোক্ষে সেই বাস্তুতন্ত্র টিকিয়ে রাখার দায়িত্বআসলে কাদের?
Advertisement