সুরের ভুবনে নজরুল যেন জাদুকর

Advertisement
49167 198
অসিকার রহমান : কোনও গানই শ্রোতার কাছে নিজেকে একেবারে নিঃশেষ করে দেয় না। যতবার শোনা যায় প্রায় ততবারই একই গানের ভিতর শ্রোতা নতুন কিছু একটা খুঁজে পায়। অনেক কিছু পাওয়া হয়ে গেলেও বারবার শোনা গানটির সুর হয়তো তার মনে এমন দাগ কেটে বসে যায় যে ভালো গানটি শোনার ইচ্ছে জাগে। ঠিক এমনি এই একই ঘটনা কবিতা পাঠের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। কবিতাটির ভাব-ভাষা-ছন্দ সবই পাঠকের জানা হয়ে গেলেও হয়তো কবিতার ছন্দ মিলের বৈভিন্নের কোনও একটি – যেমন অন্তমিল, পর্বান্তিক, পদ্যাদ্য কিংবা পর্বাদ্য মিল তার হৃদয়কে দোলা দিয়ে যায়। কবিতার এই সুরভঙ্গি তার মনে আঁচড় কাটেসে ওই একই কবিতা আবার পাঠ করতে চায়। গান ও কবিতা সেই সূত্রে একই মায়ের যমজ শিশু। এ প্রসঙ্গে আব্দুল আজিজ আল আমানের প্রণিধানযোগ্য, “আমাদের মধ্যে অনেকের ধারণা দুই বিপরীত মেরুতে কবিতা ও গানের অধিবাস, উভয়ের কুল-মান পৃথক, মধ্যকার ব্যবধান দুস্তর। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ বিপরীত। কবিতা ও গানের মধ্যে আদৌ কোনও বিরোধ নেই, দ্বন্দ্ব নেই। কেন না একই ভাবাবেগ থেকে উভয়ের জন্ম। … কাব্য ও সংগীতের মৌলিক উপাদান একই – ধ্বনি। কাব্যে এই ধ্বনি বর্ণাশ্রিত, সংগীতে স্বরাশ্রিতকাব্যে ধ্বনি লালিত্য প্রকাশিত হয় শব্দে, সংগীতে ধ্বনিমাধুর্য তরঙ্গায়িত হয় সুরে। আবার ছন্দকে আশ্রয় করেই কবিতা ও গানের জন্ম, লালন ও বর্ধন। সুতরাং একই ভাবাবেগ থেকে উভয়ের জন্ম, একই ধ্বনিকে আশ্রয় করে উভয়ের বিস্তার। এবং একই ছন্দকে অবলম্বন করে উভয়ের স্বনির্ভরতা। … উভয়ের আত্মিক যোগাযোগ বিজ্ঞান সম্মত।”
     কবিতা ও গানের সৃষ্টিক্রিয়া সাধিত হয় প্রায় একই প্রকার উপাচার বা সম্ভারে। তাই একজন কবি হয়ে উঠতে পারেন একজন সার্থক গীতিকার। বাণী ও সুরের সমন্বয়ই গান। গান শ্রবণীয় এবং গাওয়া হয় বলেই সুরের লীলায় মানুষ আকৃষ্ট হয় বেশি। সংগীতে কথার চেয়ে সুরের অবদান আধিক্য। তাই সুরকারকে অবশ্যই সুরজ্ঞ বা সুরপণ্ডিত হতেই হবে। বাংলা ভাষার দুই বিখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল শুধুমাত্র দিকপাল কবিই নন, দুজনেই বিশ্ববন্দিত গীতিকার ও সুরকার। বাংলা সংগীত জগতে এই দুই মহান কবি অত্যাশ্চর্য অবদান রেখেছেন। সুর সৃষ্টিতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, রামপ্রসাদের নামও স্মরণীয়। সংগীত জগতে এদের প্রত্যেকেরই  মৌলিক প্রকীর্তি রয়েছে।
     তখন ভারতীয় সংগীতে অন্যতম অধিপতি ছিল ধ্রুপদ। এটাই রাগ সংগীতের আদিরূপ। দক্ষিণ ভারতীয় সংগীত ধারার এই ধ্রুপদের সুর সুনির্দিষ্ট, আঁটসাঁট বাঁধনে বাঁধা। রবীন্দ্র সংগীতের প্রধান ভিত্তি হল ধ্রুপদ। স্বভাবতই সুরগুলি নির্দিষ্ট মাপে বাঁধা। তাই রবীন্দ্র সংগীতের গায়ক-গায়িকাদের কঠোর নিয়ম নীতি মেনে চলতে হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব গানেই বিষ্ণুপুরী ধ্রুপদের সুর বিদ্যমান। অবশ্য কবিগুরুর শেষ পর্যায়ের কিছু গানে বাউল, ভাটিয়ালী, কীর্তন এবং অন্যান্য সুরের স্পর্শ লেগে আছে। এই সব সুরগুলিও কিন্তু ধ্রুপদের কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত। সুরের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ শুদ্ধচারী, নিষ্ঠাবান – আসলত্বরক্ষায় অধিক যত্নশীল। সুতরাং এই গানে শিল্পীদের পক্ষে সুর বিস্তার ঘটানো বা বৈচিত্র্য আনা অসম্ভব। এর অন্যতম একটি কারণ রবীন্দ্রনাথ গানের কথাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর গানে কথার কাব্যসুষমা সযতনে লালিত। সুর এখানে অনুশাসন বদ্ধ। সুর সৃষ্টি ও প্রয়োগ মাধুর্যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের ফারাক লক্ষণীয় হলেও দুই কবিই অসংখ্য সংগীত এবং সুরের স্রষ্টা। দুজনের গানই মানুষের হৃদয়ে অম্লান হয়ে আছে। বাঙালি মনে তো স্থায়ী আসনে আসীন।
     নজরুল গীতিতে শাস্ত্রীয় বাঁধন কম থাকায় সুর বিস্তারের স্বাধীনতা প্রবল। বাণী অপেক্ষা সুরের প্রাধান্য মুখ্য বলে এই গান সুরসুধায় ভরপুর। সুরের বিচিত্র গতি, লীলার বৈচিত্র্যে বৈভিন্নে উৎকণ্ঠিত ও তরঙ্গিত। সুর সৃষ্টিতে বাংলা সংগীত জগতে নজরুল অদ্বিতীয়, কেন না তাঁর সুরের জগৎ বিস্তৃত, বর্ণাঢ্য, সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয়। নজরুল অনবদ্য এই কারণে যে তাঁর গানের সুরারোপে যে বিচিত্রময়তা তা অন্য কোনও বাঙালি সুরকারের নেই। তিনি উত্তর ভারতীয় সংগীত ধারার ঐতিহ্যবাহী খেয়াল, ঠুংরি, হোরি, কাজরী, টপ্পা, গজল, কাওয়ালী, পাহানি প্রভৃতি সুরভঙ্গিতে যে সুরমাধুর্য সৃষ্টি করেছেন তা অবিস্মরণীয়। এই প্রসঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ প্রমুখ সুরশিল্পীর নাম স্মরণযোগ্য। কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় খেয়াল ও টপ্পার সংমিশ্রণে ‘টপ-খেয়াল’ প্রবর্তন করেছিলেন। তাই তাঁর সুরে ভাঙা-খেয়ালের সূক্ষ্ম কারুকাজ সার্থকতা লাভ করে। সুরগুলি তাই শ্রুতি মধুর। তাঁর ‘কোরাস’ গানগুলি আজও সমান জনপ্রিয়। রজনীকান্ত সংগীত রচনা করেছেন রামপ্রসাদের মতো প্রাণের আবেগে। ভক্তিভাবের আকুলতা ও সুরের সারল্য এই গানগুলির জনপ্রিয়তার মূল কারণ। এই ভক্তিভাবের সার্থক উত্তরসূরি কাজী নজরুল। লখনৌ প্রবাসী অতুলপ্রসাদ তাঁর রচিত বাংলা গানে সর্বপ্রথম ঠুংরির সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারুকার্য সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছিলেন। বলতে দ্বিধা নেই ঠুংরির আমেজ প্রবর্তনের কৃতিত্ব অতুলপ্রসাদেরই। নজরুলের গানে এই আমেজ আরও বিস্তারলাভ করে।
     নজরুলের জীবন চঞ্চলময়তায় ভরা। তবু এরই মধ্যে তিনি কীভাবে সুর সৃষ্টির অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তা ভাবলে বিস্মিত হয়। প্রথাগত শিক্ষা খুব কম সময় গ্রহণ করেছেন, তাও আবার ছাড়া ছাড়া ভাবে। কবির জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সাল। পিতৃহীন হন ৮ বছর বয়সে। তখন তিনি গ্রামের মক্তবের ছাত্র। এই সময় তিনি মক্তবের শিক্ষক মৌলবি হাজি ফজলে আহম্মদের সহচর্যে আরবী আর ফারসী ভাষায় পাঠ গ্রহণ করেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে দরিদ্রক্লিষ্ট সংসারের অভাব ঘুচাতে উক্ত মক্তবে শিক্ষকতা করতে হয়, মসজিদের ইমামতিও করতে হয়। বাউলমনা নজরুলের পক্ষে এ কাজ বেশিদিন করা সম্ভব হল না। তিনি ১২ বছর বয়সে লেটো দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনেকগুলি পালাগান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। এগুলির অধিকাংশই হিন্দু সংস্কৃতি ও উপাখ্যান বিষয়ক। সেই সাথে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সংযুক্ত ছোট ছোট নাটক। একই সঙ্গে চাহিদা মত গান রচনাও করেছেন। সবই লেটোগানের জন্য। লেটোগান নজরুলের জীবনে বিভিন্ন ভাবরসের জন্ম দিয়েছিল (পরবর্তী জীবনে সার্থক ভক্তিগীতি রচনাই তার নিদর্শন)। নজরুল এখানেও থাকতে পারলেন না। বয়স তখন তার সবে এগারো টপকেছে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে, মাথরুল হাই স্কুলে। সেখানে চঞ্চলমনা কবি থাকলেন না।
     অনেক ঘাটের জল খেয়ে ময়মনসিংহ জেলার দরিরামপুর হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। এখানে নজরুলের অবস্থান মাত্র কয়েকমাস। পরীক্ষা দিয়েই পালিয়ে আসেন। এসে ভর্তি হলেন শিমারশোল রাজ হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে। এখানেই নজরুলের এ প্রজন্ত জীবনের স্থিতিকাল সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৩ বছর।
     এই সময়টুকুই নজরুলের জীবনে মহামূল্যবান। এখানে ফারসী শিক্ষক হাফিজ নূরন্ববীর কাছে খুব যত্নের সাথে ফারসী ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং তার পাশাপাশি এই স্কুলের শিক্ষক সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলালের কাছে তাঁর বাড়িতে উচ্চাঙ্গ সংগীতের পাঠ নেওয়ার সুযোগ পান। সম্ভবত এটাই নজরুলের প্রথাগত সংগীত শিক্ষা গ্রহণ। পরবর্তীকালে তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খানের কাছে। ইনি ছিলেন খেয়াল, টপ্পা, দাদরা, গজল, ধ্রুপদ প্রভৃতির সুপণ্ডিত। তাঁকে ‘ঠুংরি সম্রাট’ বলা হত। এই খান সাহেব ছাড়াও নজরুল ওস্তাদ কাদের বক্স, সস্তার গামা, সম্পুত সাহেব, পিয়ারী কাওয়াল প্রমুখ সুর বিশেষজ্ঞের কাছে সুরের তালিম নিয়েছিলেন। ওস্তাদ জমিরুদ্দীন খানকে নজরুল তাঁর ‘বনগীতি’ গ্রন্থের উৎসর্গ পত্রে ‘আমার গানের ওস্তাদ’ বলে সম্মান জানিয়েছেন। এঁদের কাছে সুরের শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি নজরুল দু’খানি বৃহৎ গ্রন্থ- যেগুলি রাগ-রাগিণী প্রকরণের ভাণ্ডার স্বরূপ তা নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ করেছিলেন। এই পুস্তক দু’টির রচয়িতা যথাক্রমে আমীর খসরু ও নওয়ার আলি চৌধুরী।
     এই সব অভিজ্ঞতালাভের ফলেই নজরুল তাঁর গানে প্রচলিত সুরের পরিবর্তে উচ্চাঙ্গ সংগীতের বহু রাগ-রাগিণীর সুর সার্থকভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাগ-রাগিণী মিশ্র ব্যবহারে নজরুল ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ডঃ বাঁধন সেনগুপ্ত লিখছেন, “এর (রাগ-রাগিণীর) মধ্যে জয়-জয়ন্তী-খাম্বাজ, নটমল্লার-ছায়ানট, ভৈরবী-আশাবরী-ভুপালী, কালাংড়া-বসন্ত হিল্লোল, বেহাগ-তিলককামোদ-খাম্বাজ, তিলককামোদ-দেশ, সিন্ধু-কাফি-খাম্বাজ, ভৈঁরো-ভীমপলশ্রী, ভুপালী-মিশ্র, সিন্ধু-কাফি, শাহানা-জয়ন্তী, ভৈরবী-পিলু, কালাংড়া-বেহাগ, বাগেশ্রী কাফি, দুর্গা-খাম্বাজ-পিলু, বেলাওলঠোটের দুর্গা, দেশ-সুরট, দেশ-পিলু, খাম্বাজ-পিলু, দুর্গা-মান্ধ, বৃহন্নট-কেদারা, জৌনপুরী-আশাবরী, বিভাস-মিশ্র, গৌরমল্লার, ইমন-বেলাওল, মেঘ-বসন্ত, হিন্দোল-শ্রীপঞ্চমী, মালকৌষ-ভৈরবী, নটনারায়ণ ইত্যাদি বাংলা সংগীতকে গৌরবান্বিত করেছে। এছাড়াও বিশুদ্ধ রাগিণীতে কবি যেসব খেয়ালগান রচনা করেছিলেন তার মধ্যে প্রধানত দরবারী, পূরবী, ভূপালী, কানাড়া, ইমনকল্যাণ, টোরী, রাগেশ্রী, হিন্দোল, মালকোষ, যোগিয়া, আড়ানা, পিলু, খাম্বাজ, বেহাগ, আশাবরী, ভৈরবী ও জৌনপুরী সমধিক উল্লেখযোগ্য। কবি নিজে স্বয়ং কিছু কিছু রাগকে বিভিন্ন রাগের সংমিশ্রণের মাধ্যমে আবিষ্কার করেছিলেন, যা ছিল একান্ত তাঁর নিজস্ব সম্পদ। তাঁর দেওয়া নামানুসারেই সেগুলি পরিচিত। এর মধ্যে নির্ঝরিণী, সন্ধ্যামালতী, বনকুন্তলা, দোলনচাঁপা, মীনাক্ষী, বেণুকা, রূপমঞ্জরী, আশা-ভৈরবী, শিবানী-ভৈরবী, অরুণ-রঞ্জনী, অরুণ-ভৈরব, উদাসী-ভৈরব, অরুণামঞ্জরী, নাগ-সারাবলী, নাগধ্বনি-কানাড়া, সুরদাসী-মল্লার, শিব-সরস্বতী, দেবযানী, রুদ্রভৈরব, যোগিনী, শংকরী, রামদাসী-মল্লার, বিজয়া, খাম্বাবতী ও ধূপমঞ্জরী অধিক পরিচিত। এই সব রাগিণী ছাড়াও কবির সৃষ্ট শাঙন, মালগুনচ, পাহাড়ী, টোরী, মান্দ, রসিয়া, জংলা প্রভৃতি রাগ-রাগিণীর অবদানও উল্লেখযোগ্য”। (নজরুল কাব্যগীতি : বৈচিত্র্য ও মূল্যায়ন, পৃষ্ঠা ১৪৫)
     নতুন রাগিণী সৃষ্টি প্রসঙ্গে নজরুলের একটি অভিমত যেটি নজরুল রচনা সম্ভার প্রথম খণ্ডের সূচীপত্রের পূর্ব পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হয়েছে সেটি স্মরণ করা যেতে পারে। “বেণুকা ও দোলনচাঁপা দু’টি রাগিণীই আমার সৃষ্টি। আধুনিক (মডার্ন) গানের সুরের মধ্যে যে অভাবটি সবচেয়ে বেশি অনুভব করি তা হচ্ছে ‘সিমিট্রি’ (সামঞ্জস্য) বা ‘ইউনিফ্ররমিটি’র (সমতা) অভাব। কোনও রাগ রাগিণীর সঙ্গে অন্য রাগ রাগিণীর মিশ্রণ ঘটাতে হলে সংগীত শাস্ত্রে যে সূক্ষ্ম জ্ঞান বা রসবোধ প্রয়োজন তার অভাব আজকালকার অধিকাংশ গানের সুরের মধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে এবং ঠিক এই কারণেই আমার নতুন রাগ রাগিণী উদ্ধারের প্রচেষ্টা”।
     যে সব রাগ-রাগিণী অপ্রচলিত, সুপ্ত, অর্ধলুপ্ত ছিল তার মধ্যে বেশ কিছু রাগিণী নজরুল তাঁর প্রতিভার নিরন্তর সাধনায় উদ্ধার করে ক্লান্তিহীন প্রয়াসে নিজের গানে ব্যবহার করেন। এগুলির মধ্যে শিবরঞ্জনী, মালগুঞ্জ, বসন্তমুখারী, পটমঞ্জরী, আনন্দী, নীলাম্বরী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া নজরুল বেশ কিছু বিদেশী সুর সম্পদকে দেশীয় সংগীতরসে নিষিক্ত করে যে বৈচিত্র্যময়তা সৃষ্টি করেছেন তার তুলনা মেলা ভার। আমীর খসরু প্রবর্তিত পারস্য দেশীয় সংগীত ঠাঁটের ব্যবহার ও তার সাহায্যে নবরাগের অনুপম রুপায়ণ নজরুলের গানে সার্থকতালাভ করেছে। ভিনদেশী সুরগুলির মধ্যে মিশরীয় সুর, আরবী সুর, নৌচকা, কিউবনি ড্যান্সের সুর প্রভৃতি উল্লেখের দাবি রাখে।
     নজরুলই সর্বপ্রথম সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতার বিনিময়ে সার্থক ‘মার্চ সঙ’-এর বীর্যব্যঞ্জক ভাবের সামঞ্জস্য সার্থক সুরের সংযোজন করেন তাঁর অধিকাংশ কোরাস গানে। এই সব সুর প্রয়োগের ফলে কেবলমাত্র মার্চ সংগীতে নয়, তাঁর দেশাত্মবোধক গানেও সুরের অপূর্ব মাদকতাময় উন্মাদনা শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে। এই পর্যায়ের গানগুলিতে ইমন ও বিলাবল, ইমন ও কেদারার মিশ্রণ, ভীমপলশ্রীর আমেজ ফুটিয়ে তুলেছেন।
     নজরুলের এমনও গান রয়েছে যেখানে শুধুমাত্র দু’টি রাগিণীর মিশ্রণ নয়, অনেকগুলির মিশ্রণ ঘটেছে। যেমন একই গানে মালকোষ-ভৈরব-মেঘ-বসন্ত-হিন্দোল-নটনারায়ণ মিলেমিশে একাকার হয়েছে বানীর বুকে। সৃষ্টি হয়েছে নতুন সুর। রাগ-রাগিণী ভাঙা-গড়ার লীলায় নজরুলের পারদর্শিতা সঙ্গীতজ্ঞদের বিস্মিত করে।
     সুর সৃষ্টি, সুরভঙ্গির বিচিত্রময়তার অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী নজরুল একধারে কবি, গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। সুরের জগতে তিনি রত্নখনি, অত্যাশ্চর্য সুর মূর্ছনা সৃষ্টিতে পারদর্শী। এই সব কারণেই তাঁর সুরের জগৎ মাদকতাময় সম্মোহনীতে পরিপূর্ণ। নজরুলের তুলনা তাই তিনি নিজেই। তাঁর অভেদ অভিন্নত্বে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
     অবশেষে ঈপ্সা-উৎসে উদ্গারিত যে, নজরুলের অসংখ্য সুর ও গানগুলির একত্রীকরণ আবশ্যক। তাই গানগুলি উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করে গানে ব্যবহৃত প্রতিটি রাগ-রাগিণী, মিশ্রসুর, সুরভঙ্গি তথা সুর প্রয়োগের পদ্ধতি-প্রকরণ ও সুর সংক্রান্ত অন্যান্য যাবতীয় বিষয় বিস্তৃতভাবে আলোচনা করে সুর ও সংগীতের উপর একটি বৃহৎ অখণ্ড আকর গ্রন্থসৃজন বিশেষ জরুরি। সুর বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় এই মহৎ কাজটি সরকারীভাবে অধিকতর সহজে উত্তমরূপে সম্পন্ন করা যেতে পারে।
     [ঋণ স্বীকার : (ক) আব্দুল আজিজ আল-আমান সম্পাদিত ‘নজরুল রচনা সম্ভার’ প্রথম খণ্ড (২য় সংস্করণ)। (খ) ড. বাঁধন সেনগুপ্তের ‘নজরুল কাব্যগীতি :বৈচিত্র্য ও মূল্যায়ন’ (২য় সংস্করণ)।]

Advertisement
Previous article১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল পরাধীন ভারতের প্রথম লড়াই
Next articleএসির ব্যবহার পরিবেশে কার্বনের বৃদ্ধিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here