সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় ও ইতিহাসের আলোয় জগন্নাথের রথযাত্রা

Advertisement
অবশেষে অবসান ঘটল সমস্ত বিতর্কের। নির্দিষ্ট সময়েই ‘গড় গড়িয়ে’ চলবে পুরীর জগন্নাথ দেবের রথের চাকা। ২২ জুন সুপ্রিম কোর্ট তার পূর্ব রায় সংশোধন করে শর্ত সাপেক্ষে সুরক্ষিতভাবে রথযাত্রার অনুমতি দিয়েছে। এবছর যদি রথযাত্রার সংস্কৃতিতে ছেদ পড়ত, তাহলে দীর্ঘ ২৮৪ বছর পর আবার ঐতিহ্য বিমুখ হত জগন্নাথ দেবের ভক্তরা। – ছবি : সংগৃহীত

সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় ও ইতিহাসের আলোয় জগন্নাথের রথযাত্রা
সোমনাথ মুখোপাধ্যায় :কথায় বলে, ‘জগন্নাথের রথ গড় গড়িয়ে চলে’। কিন্তু এবারে সেই রথের চাকা আর একটু হলেই থেমে গিয়েছিল আরকি! পুরীর রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্য (এসএস বোবদে, এএস বোপান্না ও দীনেশ মাহেশ্বরী)-এর বেঞ্চ ২২ জুন সেই রায় সংশোধন করে শর্ত সাপেক্ষে সুরক্ষিতভাবে রথযাত্রার অনুমতি দিয়েছে। উড়িষ্যা প্রশাসন ইতিমধ্যেই পুরী জেলায় সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করেছে। সারা পৃথিবীর জগন্নাথ ভক্তরা এতে খুশি।
     এবছর শুরু থেকেই রথযাত্রার বিষয়ে উড়িষ্যা সরকার কোনও সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন করোনা অতিমারীর কারণে। তাই প্রকৃত তথ্য সুপ্রিম কোর্টের সামনে যথাযথভাবে পেশ করা হয়নি। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আসরে নেমেছিলেন পুরীর শঙ্করাচার্য নিশ্চলানন্দ সরস্বতী, গজপতি মহারাজ দিব্যসিংহদেব সহ পুরীর মন্দিরে জগন্নাথের ভাই বলে কথিত দৈতাপতিদের সংগঠন। সুপ্রিম কোর্ট রথযাত্রা স্থগিত করে রায় দেওয়ার পর সেই রায় পুনর্বিবেচনা করার জন্য পুনরায় সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায় অনেকগুলি সংগঠন, যেমন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বিজেপি নেতা সম্বিত পাত্র, (এমনকি একজন মুসলিম সমর্থকও ছিলেন বলে শোনা যাচ্ছে) উড়িষ্যা সরকার সহ আরও অনেকে। সোমবার সকল পক্ষের বক্তব্য শুনে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ। রায়ে বলা হয়, কোভিড সুরক্ষার বিধি অক্ষরে অক্ষরে মেনে রাজ্য সরকার ও মন্দির কর্তৃপক্ষকে রথযাত্রা আয়োজন করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। এর জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার পূর্ণ সমন্বয় রেখে কাজ করবে।
     রথযাত্রা বন্ধ হওয়ার পর থেকে জগন্নাথ সংস্কৃতিতে সম্পৃক্ত উড়িষ্যাবাসী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। পুরীর শঙ্করাচার্য নিশ্চলানন্দ সরস্বতী মন্তব্য করেছিলেন, চক্রান্ত করে রথযাত্রা বন্ধ রাখা হচ্ছে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান সেবক গজপতি মহারাজ দিব্যসিংহ দেবও তার উষ্মা গোপন করেননি। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে মানুষের ভাবাবেগকে সম্মান জানিয়ে রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবী শ্রী তুষার মেহেতা আদালতের কাছে প্রকৃত তথ্য পেশ করে রথযাত্রা চালু করার পক্ষে সওয়াল করেন। বলা হচ্ছে, জগন্নাথ সংস্কৃতির নিয়ম অনুসারে এই রথযাত্রা অনুষ্ঠিত না হলে জগন্নাথ দেব আর ১২ বছর বাইরে যেতে পারবেন না। অথচ রথযাত্রা শুরু করার সমস্ত ধর্মীয় কৃত্য ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বাকি শুধুই রথযাত্রা।
সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় ও ইতিহাসের আলোয় জগন্নাথের রথযাত্রা
     শেষ পর্যন্ত অবশ্য রথযাত্রার সিদ্ধান্ত সকলকে খুশি করেছে। উড়িষ্যা সরকার ইচ্ছা করলে যে কোনও সময় কারফিউ জারি করতে পারে সাধারণ মানুষকে রথ থেকে দূরে রাখার জন্য। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো প্রয়োজন পড়লে যে কোনও সময় রথযাত্রা বন্ধ রাখতে পারবে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক এক জরুরী মিটিং ডেকেছেন। সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কেবলমাত্র করোনা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দৈতাপতি ও পাণ্ডাদের সহায়তায় রথযাত্রার অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন করা হবে।
     ইতিহাস ঘেঁটে যতদুর জানা যাচ্ছে, খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী থেকে পুরীতে রথযাত্রার প্রচলন হয়। উড়িষ্যার প্রাচীন পুঁথি উৎকল খণ্ড এবং দেউলতোলা থেকে জানা যায়, জগন্নাথের রথযাত্রার সূচনা হয়েছিল সত্যযুগে। যাইহোক, শবর রাজ বিশ্ববসুর পূজিত নীলমাধবই হলেন আজকের শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের প্রযত্নে সমুদ্রে ভেসে আসা নিম কাঠ থেকে স্বয়ং বিশ্বকর্মা বিষ্ণুর মূর্তি নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু ইন্দ্রদ্যুম্নের অসাবধানতায় (গুন্ডিচা দেবীর অনুরোধে) নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দ্বার খুলে দেওয়ায় মূর্তি নির্মাণ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এই মূর্তিটি নির্মিত হচ্ছিল ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রী গুন্ডিচা দেবীর বাড়িতে (যা মাসির বাড়ি নামে পরিচিত)। সেই হিসেবে গুন্ডিচা বাড়ি হল জগন্নাথদেবের জন্মস্থল। জগন্নাথদেব স্বয়ং রাজাকে আদেশ দেন, বছরে অন্তত একবার তাকে গুন্ডিচা বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। সেই রীতি ঐতিহ্য মেনে আষাঢ় মাসে শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে আবহমান কাল থেকে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে।
সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় ও ইতিহাসের আলোয় জগন্নাথের রথযাত্রা
     আসলে এই রথযাত্রা হল দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন যাত্রা। অনেকে জগন্নাথ সংস্কৃতির পিছনে বৌদ্ধ প্রভাব আছে বলেও মনে করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রথযাত্রার সময় শ্রীমন চৈতন্য মহাপ্রভু রথের সামনে ভাব বিভোর হয়ে নৃত্য করতে করতে এগিয়ে যেতেন। তাই গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের কাছে রথযাত্রার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
     তবে জগন্নাথ মন্দিরের এই রথযাত্রার ঐতিহ্য যে নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে তা নয়। বিভিন্ন সময়ে অসংখ্যবার তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। ১৫৬৮ সালে বাংলার রাজা সুলেমান করনানীর সেনাপতি কালাপাহাড় পুরীর মন্দির আক্রমণ করে। সেই সময় ১৫৬৮ থেকে ১৫৭৭ পর্যন্ত রথযাত্রার অনুষ্ঠান বন্ধ থাকে। ১৫৬৮ থেকে ১৭৩৫ সাল পর্যন্ত মোট ৩২ বছর বিচ্ছিন্নভাবে বন্ধ ছিল রথযাত্রা অনুষ্ঠান। বারবার পুরীর মন্দির আক্রান্ত হয়েছে মির্জা খুররম, কোয়াসিম খান, কল্যাণমল (রাজা টোডরমলের ছেলে), আহমেদ বেগ, একরাম খান, মহম্মদ তাকি খান প্রমুখের আক্রমণে। আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের বিগ্রহকে নানা জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে অনুষ্ঠিত হতে পারেনি শ্রীবিগ্রহের রথযাত্রা।
     যাইহোক, জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার সংস্কৃতি শুধু উড়িষ্যার নয়, আজ তা সারা ভারত সংস্কৃতির অঙ্গ। বলা বাহুল্য, রথযাত্রার দিন থেকেই দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে জগন্নাথ সবার। তাই রথযাত্রার মধ্য দিয়ে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেব মানুষের মধ্যে মহামিলনের সূচনা করেন। এবার যদি রথযাত্রার সংস্কৃতিতে ছেদ পড়তো, তাহলে ২৮৪ বছর পর আমরা আবার ঐতিহ্য বিমুখ হতাম। আমাদের সৌভাগ্য যে উচ্চ ন্যায়ালয়ের আদেশে আমরা প্রমান করতে সমর্থ হলাম, ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারি নিয়ে ঘর করি’। অতএব জগন্নাথের রথ গড়গড়িয়ে চলুক। কিন্তু এবারের জন্য শুধুমাত্র পুরীতেই।
Advertisement
Previous article‘গ্রহণ’ চলাকালে খাওয়া চলবে না, ব্যাপারটি একেবারেই গ্রাহ্য নয়
Next articleরথযাত্রা হল মানুষ ও দেবতার এক সুন্দর সহজ যোগ স্থাপন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here