যদিও সিন্ধু সভ্যতা র প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব খেলনা পাওয়া গেছে সেগুলির মান তেমন আহামরি কিছু নয়। কিন্তু উন্নত পর্যায় থেকে অবক্ষয়িত পর্যায় পর্যন্ত যেসব খেলনার নিদর্শন পাওয়া গেছে তা কিন্তু চোখ কপালে তুলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। মহেঞ্জোদড়ো বা হরপ্পা থেকে সর্বাধিক খেলনা পাওয়া গেলেও এই সভ্যতার অন্যান্য কেন্দ্র যেমন চানহুদড়ো, লোথাল, ধোলাবিরা, কালিবঙ্গান, রাখিগড়ি প্রভৃতি থেকে প্রাপ্ত খেলনার নিদর্শন বড় কম নয়।

সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে বিশ্ব ঐতিহ্য সপ্তাহ এবং শিশু দিবস উপলক্ষে ভারতীয় জাদুঘরে সিন্ধু সভ্যতায় প্রাপ্ত শিশুদের পোড়ামাটির খেলনা নিয়ে একটি প্রদর্শনী হয়েছিল। প্রদর্শনীতে মাত্র বারোটি খেলনা স্থান পেয়েছিল। সেই প্রদর্শনী দেখার পর থেকে সিন্ধুর খেলনা নিয়ে আমার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। চলতে থাকে হরপ্পা সভ্যতার খেলনা নিয়ে তথ্য অনুসন্ধান।
১৯২১-১৯২২ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহেঞ্জোদড়ো আবিষ্কারের পর থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে হরপ্পা সভ্যতার ১৪০০টি কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে। যার মধ্যে ৯২৫টি ভারতে এবং ৪৭৫টি পাকিস্তানে। বলাবাহুল্য, প্রতিবছরই এই তালিকায় নতুন নতুন কেন্দ্র সংযোজিত হয়ে চলেছে। সিন্ধু লিপির সর্বজনসম্মত পাঠোদ্ধার করা না গেলেও হরপ্পা সভ্যতা নিয়ে গবেষণা কিন্তু থেমে নেই। নতুন নতুন তথ্য ও বিশ্লেষণ সেই ধারায় সংযোজিত হয়ে চলেছে। যার সাম্প্রতিকতম সংযোজন হল হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত খেলনা নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের আগ্রহ। তবে সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে সিন্ধু সভ্যতা র আবির্ভাবকাল নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করে নেওয়া ভাল। অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক মনে করেন, হরপ্পা সভ্যতার উৎপত্তি হয়েছিল ৩৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ। যার স্থিতিকাল ছিল ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। এর মধ্যে সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত পর্যায় ছিল ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত।
সমকালীন বিশ্বে সিন্ধু সভ্যতা র সমসাময়িক সুমের বা মিশরীয় সভ্যতার তুলনায় হরপ্পা সভ্যতা ছিল সর্ব অর্থেই ব্যতিক্রমী। পোড়া মাটির ইটে নির্মিত উন্নত পয়ঃপ্রণালী ও পাকা চওড়া রাস্তা যুক্ত নগরগুলি যে শুধু স্থাপত্য শিল্পের দিক থেকে বিস্ময়কর তাই নয়, নগরবাসীদের সাংস্কৃতিক নান্দনিক ও পৌর চরিত্র ছিল রীতিমতো উঁচু মানের। নগরগুলিতে মারক অস্ত্রশস্ত্রের ঝনঝনানি না পাওয়া গেলেও সুন্দর সুন্দর খেলনার অস্তিত্ব হরপ্পার অধিবাসীদের অভিজাত জীবনযাত্রার পরিচায়ক। হরপ্পা সংস্কৃতির সমৃদ্ধ নাগরিকরা যে শিশু মনস্তত্ত্বকে অনুধাবন করার মতো পরিশীলিত জীবন বোধে উদ্দীপ্ত হতে পেরেছিলেন তার পরিচয় আমরা তাদের শিশু মনোরঞ্জনের জন্য নির্মিত খেলনাগুলির মধ্যে থেকে পেয়ে থাকি। তাছাড়া সিন্ধু সভ্যতা য় প্রাপ্ত খেলনাগুলো সিন্ধুর অধিবাসীদের নান্দনিক চেতনা ও উন্নত কারিগরি নৈপুণ্যের প্রকৌশলকে পরিজ্ঞাত করে। তাই প্রত্নতাত্ত্বিক বুর্জার আভেরি লিখেছেন, “… children’s toys, sum of which were mechanical in function. This last category of goods is perhaps the most reliable evidence of the sophistication of this society.”
যদিও সিন্ধু সভ্যতা র প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব খেলনা পাওয়া গেছে সেগুলির মান তেমন আহামরি কিছু নয়। কিন্তু উন্নত পর্যায় থেকে অবক্ষয়িত পর্যায় পর্যন্ত যেসব খেলনার নিদর্শন পাওয়া গেছে তা কিন্তু চোখ কপালে তুলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। মহেঞ্জোদড়ো বা হরপ্পা থেকে সর্বাধিক খেলনা পাওয়া গেলেও এই সভ্যতার অন্যান্য কেন্দ্র যেমন চানহুদড়ো, লোথাল, ধোলাবিরা, কালিবঙ্গান, রাখিগড়ি প্রভৃতি থেকে প্রাপ্ত খেলনার নিদর্শন বড় কম নয়। এইসব পোড়ামাটির খেলনাগুলি নির্মাণ করার জন্য যেমন দক্ষ কারিগর ছিলেন তেমনি শিশু ভোলানাথরাও নিজের ইচ্ছা মতো মাটি দিয়ে বিভিন্ন খেলনা নির্মাণ করত। এই ধরণের অপরিণত খেলনায় শিশুদের ছোট ছোট আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। পোড়ামাটি ছাড়া রোদে পোড়ানো কাঁচা মাটি ও কাঠ খেলনা নির্মাণের জন্য ব্যবহার করা হত।

খেলনার প্রায় ৯০% পোড়ামাটির তৈরি হলেও পাথর ও কাঠের ব্যবহার অপ্রতূল নয়। সাধারণভাবে খেলনাগুলির দৈর্ঘ্য ২•৫ থেকে ৫ সেন্টিমিটার হত। খুব বড় আকারের খেলনা পাওয়া যায়নি। প্রত্নতত্ত্ববিদ আর্নেস্ট ম্যাকে চানহুদড়ো থেকে যেসব খেলনার নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন তার সঙ্গে বর্তমান সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত নানা খেলনার প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় যে খেলনাটি পাওয়া গেছে সেটি হল গরুর গাড়ি। গরু বা বলদের গাড়ির নির্মাণশৈলী এতটাই নিখুঁত যে তা নির্মাণ শিল্পীর উঁচু মানের দক্ষতার পরিচায়ক। অবশ্য সিন্ধুর অপরাপর কেন্দ্রগুলি থেকেও সুন্দর সুন্দর গো-যানের নমুনা পাওয়া গেছে। কোনওটিতে হাড়ি কলসি বোঝাই। কোনও গাড়িতে গাড়োয়ান বসে আছে। কোনও গাড়িতে বড় জলপাত্র নিয়ে জল আনতে চলেছে সিন্ধুর নাগরিক। গরুর গাড়ির গরু বা বলদগুলি একেবারে আসলের মিনিয়েচার ফর্ম। সেগুলিকে ইচ্ছামতো সংযুক্ত বা বিযুক্ত করা যেত আসল গাড়ির মতোই। প্রতিটি গরুর গাড়ির গঠনও আবার এক রকম নয়। যা থেকে ধারণা করা যায় সিন্ধু উপত্যকায় নানা ধরনের গরুর গাড়ি প্রচলিত ছিল। স্থলপথে যেমন পরিবহনের প্রধান যানবাহন হিসেবে ব্যবহৃত হত গরুর গাড়ি তেমনি জলপথে চলত নৌকা। তাই শিশুদের খেলনাতেও অনিবার্যভাবে এসেছে পোড়ামাটির তৈরি নৌকা।
গরুর গাড়িগুলো খেলনা মডেল হলেও সেগুলি কিন্তু সচল ছিল। শক্ত পোড়ামাটির চাকাগুলো খোলা বা লাগানো যেত। গরুর গাড়ির পোড়া মাটির ফ্রেমে ছোট ছোট টুকরো কাঠ লাগানোর জন্য চারটি ছিদ্র থাকত কালের নিয়মে কাঠগুলো নষ্ট হয়ে গেলেও ছিদ্রগুলি বর্তমান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ধরনের গরুর গাড়ি এখনও পর্যন্ত সিন্ধু এলাকায় প্রচলিত আছে।
গরুর গাড়ি ছাড়া বিভিন্ন জীবজন্তুর খেলনা পাওয়া গেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বলদ, কুঁজ যুক্ত ষাঁড়, গরু, মহিষ, কুকুর, শুয়োর, ভেড়া, হাতি, গন্ডার, কুমির, বাঁদর, সাপ, নেউল, কাঠবিড়ালি, হাঁস, কচ্ছপ, ময়ূর ,পায়রা, নানা ধরনের পাখি প্রভৃতি। পাখির খেলনাগুলি এতটাই নিখুত যে তাদের হাঁস, ময়ূর, পায়রা কিংবা কাকাতুয়া বলে খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায়। এইসব পাখির খেলনাগুলির কোনও কোনওটি হুইসেল বা ঝুমঝুমি হিসেবে বাজানো যেত। পাখির কোনও কোনও খেলনায় পায়ের পরিবর্তে চাকা লাগানো থাকত। যাতে সেগুলো গাড়ির মতো টেনে নিয়ে যাওয়া যায়। পাখির জন্য টেরাকোটার খাঁচাও নির্মাণ করা হয়েছে। যার নিদর্শন রয়েছে দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়াম ও লোথালের সাইট মিউজিয়ামে।
বিভিন্ন জীবজন্তুর যেসব খেলনা মডেল পাওয়া গেছে তার মধ্যে বেশ কিছু খেলনার মুণ্ডগুলি নাড়ানো, খোলা কিংবা ঘোরানো যেত। এর জন্য মুণ্ডুগুলি আলাদা করে নির্মাণ করে তামার তার বা কাঠি দিয়ে পশুর ধড়ের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হত। কখনও কখনও সংশ্লিষ্ট জায়গায় ছিদ্র করে রাখা হত। হরপ্পার শিশুরা নানা ধরনের লাট্টু খেলনা হিসেবে ব্যবহার করত। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে নানা ধরনের ছোট বড় লাট্টুর নিদর্শন পাওয়া গেছে। খেলার জন্য আধুনিক যুগের মতো পোড়ামাটির ছোট ছোট রন্ধন পাত্র ও বিভিন্ন আসবাবপত্র পাওয়া গেছে। যার মধ্যে পোড়ামাটির তৈরি একটি বিছানা আমাদের কৌতুহল উদ্রেক করে। কারণ তার গায়ে কাপড়ের ছাপের চিহ্ন দিয়ে চাদরের বিষয়টি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে ঢাকনা সহ গামলা, কলসি, জার, পোড়ামাটির রান্নাবাটি খেলার সেট, মার্বেল প্রভৃতি। এইসব পোড়া মাটির জীবজন্তু ও নিত্য ব্যবহার্য জিনিস নিয়ে খেলার মধ্যে দিয়ে শিশুরা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করত।
সিন্ধুর খেলনা পুতুলগুলির মধ্যে একটি অদ্ভুত সুন্দর বাঁদরের খেলনা পাওয়া গেছে। ভাবুক বাঁদরটি একটি লাঠি হাতে বসে আছে। যার শিল্প নৈপুণ্য দেখলে অভিভূত হতে হয়। আরেকটি এমন বাঁদর পাওয়া গেছে যাকে সরু দড়ির সাহায্যে ওঠানো নামানো যেত। এছাড়া মানুষ ও পশুর এমন ছোট ছোট পুতুল পাওয়া গেছে যার হাত-পাগুলি খোলা বা লাগানো যেত।

মাটির তৈরি অসংখ্য গোলক ধাঁধা পাওয়া গেছে যেগুলি ঠিক আধুনিক যুগের মতো। যদিও তার বল খুঁজে পাওয়া যায়নি। সম্ভবত গাছের বীজ বা ছোট ছোট পুঁথি খেলার জন্য ব্যবহৃত হত। পোড়া মাটি ও পাথরের তৈরি পাটায় ছক কাটা গুটিসহ পাশা পাওয়া গেছে। যাকে দাবার আদি নিদর্শন বলে গণ্য করা যায়। এছাড়া আধুনিক লুডোর ছক্কার অনুরূপ পোড়ামাটির ডাইস পাওয়া গেছে। যার প্রতিটি তলে এক থেকে ছয় পর্যন্ত ডট দিয়ে চিহ্নিত আছে। যা সিন্ধুর অধিবাসীদের সংখ্যা গণনার অপূর্ব নিদর্শন। মহাভারতের যুগে যে চতুরঙ্গ খেলার প্রচলন ছিল সেই ধরনের খেলা সিন্ধু সভ্যতা তেও প্রচলিত ছিল বলে মনে করা হয়। এই ডাইসগুলি কিন্তু এত বছর পরেও নতুনের মত ঝকঝকে আছে। যা থেকে ধারণা করা যায় এগুলি কাপড়ের মতো নরম কিছুর ওপরে রেখে খেলার জন্য ক্ষয়প্রাপ্ত হয়নি।
সিন্ধু উপত্যকার শিশুদের মধ্যে আরেকটি জনপ্রিয় খেলার প্রচলন ছিল। যাকে আমরা বলি সাত গুটি বা পিট্টু। একটি বল দিয়ে সাতটি গুটি সাজিয়ে তাকে আঘাত করে ভেঙে ফেলা হয়। প্রতিপক্ষের ছেলেরা সেই গুটিগুলি দিয়ে দ্রুত তা পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করে। এই খেলার জন্য প্রয়োজনীয় মাটির চাকতি সিন্ধু উপত্যকায় প্রচুর পাওয়া গেছে। গবেষক দীপন ভট্টাচার্য সিন্ধু উপত্যকার কেন্দ্র থেকে একটি ফায়ান্সের তৈরি সুদৃশ্য নীল রংয়ের শিশুদের খেলনা বল উদ্ধার করেছেন। সম্ভবত শিশুরা কাপড়ের তৈরি বা এই ধরনের ফায়ান্সের বল দিয়ে পিট্টু খেলায় মেতে উঠত।
সিন্ধু উপত্যকায় নানা ধরনের পোড়ামাটি, কাঠ, পাথর ও ফায়ান্সের খেলনা পাওয়া গেলেও একমাত্র খেলনাপাতির ছোট ছোট বাসন-কোসনগুলি ছাড়া মেয়েদের উপযোগী তেমন কোনও খেলনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে এটা অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে মেয়েদের জন্য নিশ্চয়ই মাটি ও কাপড়ের তৈরি পুতুল ব্যবহৃত হত। যা কালের নিয়মে বিনষ্ট হয়ে গেছে।
হরপ্পা সভ্যতা ছাড়া সমকালীন আর কোনও তাম্রব্রঞ্জ যুগের সভ্যতায় এত বৈচিত্র্যময় খেলনার নিদর্শন পাওয়া যায়নি। খেলনাগুলি যে শুধুমাত্র শিশু মনোরঞ্জনের জন্য ব্যবহৃত হত তা নয়, সেগুলি সিন্ধুর শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার উপকরণ হিসেবেও ব্যবহৃত হত। তারা এই খেলনাগুলির মাধ্যমে তাদের পারিপার্শ্বিক জগত ও তার সাথে তাদের সম্পর্ক, নিত্যনৈমিত্তিক জীবন যাপনের কর্মপদ্ধতি, গাণিতিক দক্ষতা বৃদ্ধি সহ নানা বিষয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করত। বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ কমলা ডঙ্গেরকেরি খেলনাগুলির গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন, “educational research has led to the production of a number of toys which assist in sensory training and mathematical calculation, and teach children to acquire skill in doing various things.” ঠিক যে পদ্ধতি বর্তমানে আধুনিক প্লে স্কুলগুলিতে অনুসরণ করা হয়ে থাকে। সব মিলিয়ে বলা যায় যে এখন থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতা য় শিশুরা বিশেষ আদর ও যত্নে বেড়ে উঠত যেমনটা আধুনিক উন্নত সভ্য সমাজে লক্ষ্য করা যায়।