১৯১০ সালে ভবানীপুরে কতিপয় যুবক ও ব্যবসায়ীদের মিলিত প্রচেষ্টায় একটি সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এবং সেই সভার সদস্যরা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে বঙ্গে প্রথম সার্বজনীন দুর্গা পুজোর আয়োজন করেন। বলা বাহুল্য, এই পুজোতেই প্রথম অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণকে। এরপর ধীরে ধীরে এই সার্বজনীন দুর্গা পুজো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বঙ্গদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

রেমা মণ্ডল : রাজা নেই, তাই তার কোনও ভূমিকাও নেই। বঙ্গদেশে এক সময়ে রাজা বা জমিদারদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল বাংলার সবচেয়ে বড়ো উৎসব দুর্গোৎসবের। যদিও সে সময়ে এই উৎসবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেত না জনসাধারণ। তবে সময় পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর সেই সঙ্গে রাজা বা জমিদারদের দিনও ফুরিয়েছে। উৎসবেও ঘটেছে একাধিক পরিবর্তন।
যে উৎসবে অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল না জনসাধারণের, আজ সেই দুর্গোৎসবই বাঙালির সবচেয়ে বড়ো উৎসবে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ দুর্গোৎসব আজ সার্বজনীনে রূপ পেয়েছে। রাজা বা জমিদারদের হাত ধরে দুর্গা পুজো শুরু হলেও কয়েক দশকের মধ্যেই এই পুজো বারোয়ারী পুজোই পরিণত হয়। তখন সীমিত কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এই পুজো। বলতে গেলে তখনও মা দুর্গা পুরোপুরি জনসাধারণের হতে পারেনি।
তবে হতেও খুব বেশি সময় নেয়নি। ১৯১০ সালে ভবানীপুরে কতিপয় যুবক ও ব্যবসায়ীদের মিলিত প্রচেষ্টায় একটি সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এবং সেই সভার সদস্যরা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে বঙ্গে প্রথম সার্বজনীন দুর্গা পুজোর আয়োজন করেন। বলা বাহুল্য, এই পুজোতেই প্রথম অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণকে।
এরপর ধীরে ধীরে এই সার্বজনীন দুর্গা পুজো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বঙ্গদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ১৯১৩ সালে কলকাতার শিকদার বাগানে এবং ১৯১৯ সালে লেবুবাগানে শুরু হয় একই কায়দায় চাঁদা তুলে এই সার্বজনীন দুর্গা পুজো।
আসলে পাঁচদিনের এই মহা উৎসবের খরচ অন্য যে কোনও পুজোর থেকে অনেকটাই বেশি। বাংলায় জমিদাররা ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করলে এই পুজোর সংখ্যাও কমতে শুরু করে। এবং এর পাশাপাশি ফিকে হতে শুরু করে এই উৎসবের জৌলুসও। তখন এর হাল ধরতে এগিয়ে আসে জমিদার পরিবারের বাইরের মানুষেরা। প্রথমে কয়েকজনের মিলিত প্রচেষ্টায় বারোয়ারী এবং তারপর সমাজের সর্বস্তরের মানুষের থেকে চাঁদা তুলে সার্বজনীন আকারে চলতে থাকে এই পুজো।

যদিও কিছু কিছু জমিদার পরিবারের বংশধরেরা আজও তাঁদের পুরনো ঐতিহ্য বজায় রেখে এককভাবে দুর্গা পুজো করে চলেছেন। যে পুজো বনেদী বাড়ির পুজো নামেই বেশি পরিচিত। কিন্তু সার্বজনীন দুর্গা পুজোর গ্রহণযোগ্যতা এখন সবচেয়ে বেশি।
এই প্রসঙ্গে আরও একটি পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে। পূর্বে দুর্গা প্রতিমা সাজানো হত একচালায়। সেসময়ে একচালার মধ্যেই মা দুর্গাকে মধ্যমণি করে তার দুই পাশে নির্মাণ করা হত লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক এবং তাদের বাহনদের। এই রীতিতে দীর্ঘদিন মূর্তি নির্মাণ হয়ে এসেছে। যদিও এখনও এই একচালা রীতিতে অনেক স্থানেই প্রতিমা নির্মাণ করা হয়।
পরে সার্বজনীন দুর্গা পুজোর সূচনা ঘটলে এই রীতি ভাঙতে শুরু করে। ১৯৩৩ সালে গোপেশ্বর পাল নামে এক প্রতিমা শিল্পী প্রথম একচালা ভেঙে পাঁচচালার প্রতিমা নির্মাণের প্রচলন করেন। এই নতুন রীতিতে তিনি মা দুর্গার দুই পাশ থেকে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিক-কে নামিয়ে আলাদা আলাদা চালায় স্থান দেন। তবে অসুরকে তিনি মা দুর্গার সঙ্গে তার চালাতেই রাখেন। তাঁর প্রচলিত এই নতুন পাঁচচালা রীতিতে প্রথম দুর্গা পুজো হয় কলকাতা কুমোরটুলি অঞ্চলের একটি সার্বজনীন পুজো মণ্ডপে।
বলা বাহুল্য, তারপর থেকেই ধীরে ধীরে এই পাঁচচালা রীতির গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। আর এখন তো যে কোনও সার্বজনীন পুজো মণ্ডপে আবশ্যিকভাবে দেখা মিলবে এই পাঁচচালা রীতির দুর্গা প্রতিমা।
খুব সুন্দর লাগলো প্রতিবেদন টি পড়ে।সাধু সাধু।