এমন কিছু জীবনদায়ী ওষুধ রয়েছে, যা শুধুমাত্র সাপের বিষ সহযোগেই তৈরি করা সম্ভব। তাছাড়া সাপ বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় অনেক বড়ো ভূমিকা রাখে। তবুও বিনা কারণে তাদেরকে মরতে হয় মানুষের হাতে। পাহারপুরের এককালের সাপুড়ে মশান বাউরি ২১ বছর আগেই ‘সাপ খেলা’ দেখানো ছেড়ে দিয়েছেন। এখন অনুরোধ করেন সাপ মারা থেকে বিরত থাকতে। – ছবি : সংগৃহীত |
জয়দেব দেবাংশী : এই বিশ্ব প্রকৃতিতে সাপেরও অধিকার আছে। সাপও পরিবেশের একটি বিশেষ অংশ। বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় সাপের ভূমিকা অনেক। জীবন বিজ্ঞানের বাস্তুতন্ত্র পাঠ্যংশে খাদ্য-খাদক সম্পর্কিত যে উদাহরণটি সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয়, সেখানে অন্য কোনও কিছু না ভেবে সাপ আর ব্যাঙের সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে।
তবে এক্ষেত্রে শুধু ব্যাঙ কেন, সাপের সঙ্গে ইঁদুরের উদাহরণ দিলেও আশ্চর্যের কিছু থাকত না। প্রতি বছর এই মূষিক সম্প্রদায়ের হাতে লক্ষ লক্ষ টাকার সরকারি বা বেসরকারি সম্পত্তি, বিশেষ করে খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে যায়। পরিবেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে পূর্বের মতো সাপের অস্তিত্ব থাকলে ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমলেও কমতে পারত। তবুও মূষিক সম্প্রদায় এখনও যতটুকু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তার একটি বড়ো কারণ অবশ্যই সাপের উপস্থিতি। এছাড়াও ইঁদুর থেকে ছড়িয়ে পড়া প্লেগ মহামারীকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সাপ।
শুধু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থেই নয়, মানব সমাজের কাছে সাপের ভূমিকা অনেক। সাপের বিষকে কাজে লাগিয়ে এমন কিছু ওষুধ তৈরি হয়, যার কোনও বিকল্প এখনও পর্যন্ত নেই। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় একমাত্র যে অ্যান্টি-ভেনম (AVS-1)-এর ব্যবহার করা হয় সেটি তৈরি করতেও সাপের বিষের প্রয়োজন পড়ে। এছাড়াও হিমোফিলিয়া, ক্যান্সার, বাত, কুষ্ঠ প্রভৃতি রোগের ওষুধে সাপের বিষ ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু এতকিছুর পরেও সাপের মৃত্যু সেই মানুষের হাতেই ঘটে থাকে। অথচ কোনও কালেই মানুষের সঙ্গে সাপের শত্রুতা ছিল না। নিজের অনিষ্ঠ না হলে বা আঘাত না পেলে সাপ কখনই মানুষকে দংশায় না। নিজেকে নিজের মতো করে রক্ষা করার অধিকার এই বিশ্বে সবারই থাকে। সাপও এর থেকে ভিন্ন নয়। নিজেকে রক্ষা করতে সাপ তাই অন্যকে দংশাতে বাধ্য হয়।
যদিও ভারতীয় প্রশাসন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উপর ইদানিং বিশেষ জোর দিয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বন্যপ্রাণী মারা, ধরা, পোষা, বিক্রি করা, খেলা দেখানো এই দেশে এখন আইন মোতাবেক দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রকৃতপক্ষে সাপও একটি বন্যপ্রাণী। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশাসনের এই নির্দেশ সাপের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
তা সত্ত্বেও দৃষ্টি শক্তির সীমান্তে দেখা মাত্রই মানুষ তেড়ে যায় সাপ মারতে। এটা সত্য, প্রতিবছর প্রায় সারা ভারতবর্ষে ২০-২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে শুধুমাত্র সাপের কামড়ে। এর মধ্যে বর্ষাকালেই সর্পাঘাতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। মানুষ ভয়ে বা আতঙ্কেই সাপকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। তবুও কিছুটা সচেতন হলেই এদেরকে রক্ষা করা সম্ভব।
প্রায় ২১ বছর আগে ‘সাপ খেলা’ দেখাতেন বীরভূম জেলার পাহাড়পুর গ্রামের মশান বাউরি। তাঁদের একটি সাপুড়ে দলও ছিল। এই দলের সর্দার ছিলেন বিদেশী বাউরি। মশান বাউরি জানালেন, এক সময়ে প্রচণ্ড অভাবের তারনায় তাঁরা এই সাপুড়ে দলটি করেছিলেন। ঝোপ, ঝাড়, জঙ্গল থেকে বিষধর সাপ সংগ্রহ করে প্রথমেই তাদের বিষদাঁত ভেঙে দিতেন। তারপর রেখে দিতেন বাঁশের ঝাঁপিতে। খেতে দিতেন ব্যাঙ, ছোটো মাছ। দল বেধে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বেরিয়ে পড়তেন ‘সাপ খেলা’ দেখাতে। বেশ ভালোই রোজগার হত তখন। ঝাঁপি থেকে সাপ বের করে ডুগডুগি বাজিয়ে গাইতেন ঝাঁপান গান। সাপ রেগে গিয়ে মাথা নাড়িয়ে ফোঁসফাঁস করত। দর্শক ভাবত গানের সুরে সাপ নাচছে। অথচ সাপ আদৌ শুনতে পায় না। গান শুনে নাচবে কীভাবে?
মশান বাউরি আরও জানালেন, একবার শশীধরপুরের খেলার মাঠে চড়কের মেলায় গিয়েছেন ‘সাপ খেলা’ দেখাতে। সেখানে খেলা দেখানোর মাঝেই সর্দার বিদেশী বাউরিকে অসাবধানতায় ছোবল খেতে হয় সাপের কাছে। বিদেশী বাউরি আর বেঁচে ফিরতে পারেননি। এরপর থেকেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, সাপের খেলা আর নয়। পরে সংগৃহীত সাপগুলিকে মশান বাউরি বক্রেশ্বর নদের ধারের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসে।
তবে সাপেদের সঙ্গে এতকাল বসবাস করে যেন সখ্যতা গড়ে উঠেছে মশান বাউরির। সাপ মারা একেবারেই পছন্দ নয় তার। সবাইকে অনুরোধ করেন সাপ মারা থেকে বিরত থাকতে।
শুধু মশান বাউরি নন, বীরভূম জেলার অজয়পুর হাইস্কুলের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক দীনবন্ধু বিশ্বাসও সাপ মারার বিরুদ্ধে। তিনি আবার ওয়াইল্ড লাইফ কন্ট্রোল ব্যুরোরও একজন সদস্য। ২০১৯ সালে শিক্ষারত্ন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি বনদফতরের সহযোগিতায় বিষধর সাপ উদ্ধার করে পুনর্বাসন দিয়ে আসেন নিয়মিত। তিনি এবছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ২০০টি সাপ উদ্ধার করে বনদফতরের হাতে তুলে দিয়েছেন। তার মধ্যে ৬০টি ছিল অত্যন্ত বিষধর। দীনবন্ধুবাবুও নিয়মিত প্রচার করেন সাপ না মারা ও সংরক্ষণের জন্য।