Advertisement
বীরভূম জেলার সাংড়া গ্রামের জমিদার বংশের ইতিহাস ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের সমসাময়িক বা তার থেকেও পুরনো। তখন জমিদার ছিলেন সারদা সরকার। দেশে পত্তনী প্রথা চালু হওয়ার পর এই অঞ্চলের জমিদারির দায়িত্ব পান বেচারাম মুখোপাধ্যায়। পরে ১৯১৫ সাল নাগাদ মাত্র ১৬ বছর বয়সে জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন সত্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁকে সাংড়া গ্রামের রূপকার বলা হয়ে থাকে। তাঁর মতো প্রজা দরদী জমিদার এই বাংলায় খুবই কমই ছিল। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি
|
সুজয় ঘোষাল ও রেমা মন্ডল :ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গিয়েছিল বাংলার জমিদারি শাসনও। জমিদার না থাকলেও অবশ্য কোথাও কোথাও এখনও টিকে রয়েছে সেযুগের জমিদারদের ব্যবহৃত বাড়িগুলি। যা ‘জমিদার বাড়ি’ নামে সর্বাধিক পরিচিত। একে বাড়ি না বলে অট্টালিকা বলা-ই ভালো। সুবৃহৎ ও গগনচুম্বী এই অট্টালিকাগুলি আঞ্চলিক মানুষের কাছে ‘বাবুবাড়ি’, ‘রাজবাড়ি’, ‘বনেদি বাড়ি’ নামেও পরিচিত ছিল বা এখনও রয়েছে।
এই সমস্ত জমিদার বাড়িগুলির অধিকাংশই এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। যদিও পূর্বের খোল নলচে বদলে এরই কয়েকটি আবার সংস্কারপ্রাপ্ত হয়ে আদ্যিকালের আভিজাত্য অক্ষুণ রেখেছে। বীরভূম জেলার এরকমই একটি জমিদার বাড়ির অস্তিত্ব রয়েছে সাংড়া গ্রামে। সাংড়া গ্রামটির অবস্থান আমোদপুর-সিউড়ি সড়কে।
সাংড়া গ্রামের জমিদার বংশের ইতিহাস ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দের সামসাময়িক বা আরও কিছু পূর্বের। সম্ভবত এই অঞ্চলের প্রথম জমিদার ছিলেন সারদা সরকার। তবে তিনি সাংড়া অঞ্চলের স্থায়ী জমিদার ছিলেন না। খুব সম্ভব তিনি সুরুল বা কীর্ণাহার অঞ্চলের স্থায়ী জমিদার ছিলেন। পরবর্তীকালে পত্তনী প্রথা চালু হলে বেচারাম মুখোপাধ্যায় সারদা সরকারের কাছ থেকে জমি পত্তন বা ইজারা নেন। তাঁর আদি নিবাস ছিল চব্বিশ পরগনা জেলার খরদহ গ্রামে। সাংড়া ছাড়াও পাশ্ববর্তী পশোয়া, সোমসা, বনমালডিহী, নিরিশা, শালগড়িয়া, পাড়গ্রাম গ্রামগুলিও তাঁর জমিদারির অংশ ছিল। এছাড়াও মূয়রেশ্বর থানার বাসুদেবপুরেও তাঁদের মাহাল ছিল। বেচারাম মুখোপাধ্যায় সাংড়া গ্রামের জমিদারি পাওয়ার পর তাঁর অংশের তিনভাগ নিজে দেখাশোনা করতেন এবং বাকিটা তাঁর ভাইদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছিলেন।
এবার আসা যাক জমিদার সত্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে। যাঁকে সাংড়া গ্রামের রূপকার বলা হয়ে থাকে। তাঁর মতো প্রজা দরদী জমিদার খুব কমই ছিল এই বাংলায়। বেচারাম মুখোপাধ্যায়ের পর তাঁর পুত্র সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় খুব বেশি দিন জমিদারি চালাতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯১৫ সাল নাগাদ মাত্র ১৬ বছর বয়সে জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন সতীশবাবুর পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
জমিদার সতীশবাবুরও ছিলেন একজন প্রজাবৎসল জমিদার। তাঁর স্বপ্ন ছিল গ্রামে শিক্ষার উন্নতির জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করার এবং সেই সঙ্গে গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থারও প্রভূত উন্নতি ঘটানোর। কিন্তু অল্পদিনেই তাঁর মৃত্যুর হওয়ায় সেই স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়। পিতার অসম্পূর্ণ কাজ বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব নেন সত্যেন্দ্রনাথবাবু।
প্রথমেই তিনি শিক্ষার দিকে নজর দিলেন। তখন বিদ্যালয় বলতে নানুবাজার অঞ্চলে অমিল পন্ডিতের একটি পাঠশালা ছিল। পরবর্তীকালে হাতিয়াগ্রাম নিবাসী মন্থননাথ মুখোপাধ্যায় ও পতিনাথ ঘোষ নামে দু’জন শিক্ষককে নিয়ে নানুবাজারে একটি প্রাথমিক স্কুল স্থাপন করলেন সত্যেন্দ্রনাথবাবু। পরে এই স্কুলটি সাংড়া গ্রামে স্থানান্তরিত করা হয়। সেটি সরকারীভাবে অনুমোদন পেয়ে প্রথমে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত, পরে সিনিয়র বেসিক স্কুলে পরিণত হয়। বর্তমানে এই স্কুলটির আরও উন্নতি সাধন ঘটে সাংড়া গ্রামের উত্তর সীমান্তে সতীশচন্দ্র মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়েছে।
গ্রামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ছিল বরাবরই সঙ্গিন। বাবা সুচিকিৎসার অভাবে মারা যান। তাই সাংড়া গ্রামে স্বাস্থ্য পরিষেবার মান উন্নয়ন করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথবাবু। পিতার প্রতিষ্ঠিত পরিত্যাজ্য মাইনর স্কুল ঘরেই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার জন্য দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে তুললেন। পরে সেখানে এলোপ্যাথিক চিকিৎসারও বন্দোবস্ত করা হয়। প্রথমে খরচ চালানোর জন্য নিজ তহবিল থেকে টাকা দিতেন। পরে জেলা বোর্ড থেকে অর্থ সাহায্য আসতে শুরু করে। পরে তিনি ৬ বিঘা জমি দান করেন দাতব্য স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির নাম রাখলেন পিতা ও মাতার স্মৃতিতে। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেই সতীশচন্দ্র শ্বেতবরণী চিকিৎসালয়টি আজ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের রূপ নিয়েছে।
সাংড়া অঞ্চল বরাবরই কৃষিপ্রধান। গ্রামে আখ চাষের সুনাম ছিল। মূর্শিদাবাদ থেকে বণিকরা আসত আখ কিনতে। কৃষিকাজে সুবিধার জন্য কৃষকরা যাতে ঋণ নিতে পারে, তার জন্য এই গ্রামে একটি সমবায় ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠা করেন সত্যেন্দ্রনাথবাবু এবং ১০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি কৃষি সংগ্রহশালাও নির্মাণ করেন। এছাড়াও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য তিনি রাস্তা সংস্কারের পাশাপাশি ডাকঘর গড়ে তোলারও ব্যবস্থা করেন।
সেযুগে জমিদার আর প্রজার মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব থাকাটা-ই ছিল স্বাভাবিক। প্রজার সঙ্গে জমিদারের দৃষ্টিবিনিময় খুব কমই হত। কিন্তু জমিদার সত্যেন্দ্রনাথবাবু এই প্রথায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি যতটা পেরেছেন এই দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা করেছেন আজীবন। প্রত্যেক বৈশাখে পালকি কিংবা ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে ঘুরতেন ‘পূর্ণাহ’ অনুষ্ঠান করতে। সেখানে জমিদারকে দেখতে আসত প্রজারা। খাজনা নেওয়ার পাশাপাশি প্রজাদের সমস্যার কথাও শুনতেন মনোযোগ দিয়ে।
যদিও জমিদারি প্রথা এখন আর নেই। নেই জমিদারও। কিন্তু আজও পড়ে রয়েছে জমিদার সত্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সেই জমিদার বাড়িটি। আজও সাংড়া গ্রামের জমিদার বংশের স্মৃতি বহন করে চলছে এই সুরম্য অট্টালিকা। তবে আর পাঁচটা জমিদার বাড়ির মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়নি এটি। বরং সংস্কার করে পুরনো ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে যত্ন করে।
চলতি পথ থেকেই দেখা মিলবে জমিদার বাড়ির প্রধান ফটকটি। প্রাচীন শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় আজও জীবন্ত হয়ে রয়েছে এর নকশার কারুকার্য। বাড়িটি দুই মহলে ভাগ করা। এই বাড়ির দেওয়ালগুলিও চমৎকার অলংকৃত। সেখানে অনন্যা স্থাপত্য শৈলীর দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে। দেওয়ালের অলংকরণে বিভিন্ন নকশা ছাড়াও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ফুল, সিংহ, টিয়া পাখির প্রতিকৃতিতে। তবে এত বড়ো বাড়িতে বছরের অধিকাংশ সময় জমিদার বংশের প্রায় কেউ উপস্থিত না থাকলেও নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে কড়া নিরাপত্তায় আবৃত থাকে।
গ্রন্থঋণ :
১. ‘আমার জন্মভূমি’, সত্যেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
২. তারাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় (আমোদপুর জয়দূর্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন বাংলা শিক্ষক)
৩. সত্যনারায়ণ মণ্ডল (সাংড়া গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা)
৪. অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য (আমোদপুর জয়দুর্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন বিজ্ঞান শিক্ষক)
Advertisement