ওঁরাও সম্প্রদায় বীরভূম জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করেছে। তাঁদের অন্যতম প্রধান উৎসব ‘করম’। এই উৎসবকে আবার ‘বৃক্ষ পুজো’-ও বলা হয়ে থাকে। সাধারণত প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশীতে এই পুজোর আয়োজন করা হয়। যদিও এবছর করোনা মহামারির জন্য অনেক স্থানেই এই উৎসবের আয়োজন করা হয়নি। তবে সাঁইথিয়া ব্লকের নওয়াপাড়ায় যথেষ্ট সচেতনতার বিধি মেনে করম উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |
সুজয় ঘোষাল : বীরভূম জেলার সাঁইথিয়া ব্লকের ভ্রমরকোল গ্রাম পঞ্চায়েতের নওয়াপাড়া একটি আদিবাসী অধুষ্যিত গ্রাম। অন্য সাঁওতাল উপজাতির সঙ্গে এখানে ১০-১৫টি ওরাঁও পরিবার বসবাস করছে। প্রতি বছরের মতো এবছরও তাঁরা ‘করম উৎসব’-এর আয়োজন করেছিলেন। সাধারণত অবিবাহিত পুরুষ ও নারীরা এই পুজোয় সামিল হন।
আসলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘ওরাঁও’ অন্যতম একটি পিছিয়ে পড়া উপজাতি। সুদূর অতীত থেকেই বীরভূম জেলার বিভিন্ন অংশে এঁরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে। এঁদের প্রচলিত প্রধান উৎসবের মধ্যে ‘করম পুজো’ বা ‘করম উৎসব’ অন্যতম। সাধরণত ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশীতে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ‘করম পুজো’ অরণ্যকেন্দ্রিক শস্য উৎসব হলেও এই উৎসবটিকে অনেক সময় ‘বৃক্ষ পুজো’-ও বলা হয়ে থাকে।
করম পুজোর বর্ণনা অন্য পুজোর থেকে কিছুটা আলাদা। উৎসবের আগের দিন ওরাঁও সমাজের পুরুষরা বনে গিয়ে করম গাছের ডাল কেটে আনেন। এখানে করম গাছ বলতে মহুয়া গাছকে বোঝানো হয়েছে। তারপর কিছুটা নাচের ছলে বন থেকে বেরিয়ে তাঁরা ডালটিকে গ্রামে প্রবেশের মুখে নারীদের হাতে তুলে দেন। নারীরা আবার নাচের তালে গ্রামে তৈরী করা একটি মাটির বেদিতে গাছের ডালটিকে স্থাপন করেন। এই ডালটিকে স্থাপন করার সময় ওরাঁও সমাজের প্রধান পুরোহিত ও সহ পুরোহিত উপস্থিত থাকেন।
করম পুজোর এক সপ্তাহ আগেই ওরাঁও মেয়েরা মাটির পাত্রে কিছু ছোলা, মুগ বা ধান রেখে সেগুলিকে অঙ্কুরিত করেন। ভাদ্র মাসের শুক্লা চতুর্থী থেকে পুজোর দিন পর্যন্ত মেয়েরা প্রদীপ ও ধূপ জ্বেলে শস্যদানার পুজার্চনা করেন। করম ডাল স্থাপনের পর পুরোহিত ঘট প্রতিস্থাপন করে পুজো শুরু করেন।
![]() |
করম পুজোর বেদি |
এরপর অঙ্কুরিত শস্যদানা ও ফুল-ফল দিয়ে অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়। পুজো চলাকালে কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে নাচতে থাকেন। এছাড়াও কাঁচা বাবুই ঘাস তুলে কিছুটা চাবুক সাদৃশ্য করা হয়। তারপর ইচ্ছানুযায়ী নারী-পুরুষ উভয়েই হাত প্রসারিত করলে অন্য দুজন প্রসারিত হাতে তিনবার আঘাত করতে থাকেন। ওঁরাও সম্প্রদায়ের বিশ্বাস এইভাবে আঘাত করলে নাকি সারা বছরই রোগ থেকে নিস্তার পাওয়া যায় এবং করাম রাজার ‘বর’ পাওয়া যায়। এইভাবে সারাদিন পুজো চলার পর রাতে মাদল, লাগড়া সহযোগে শুরু হয় ঝুমুর নাচ ও করম গান। পরদিন সকালবেলায় সেই করম গাছের ডালটিকে পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়।
পুজোর প্রধান পুরোহিত বীরু বাবু জানালেন, “সাধরণত করম পুজো গ্রামের কল্যাণ ও উন্নতির জন্য করা হয়ে থাকে। আমাদের ওরাঁও জনগোষ্ঠীর লোককথায় করম ও ধরম নামে দুই যমজ ভাইয়ের নাম উল্লেখ রয়েছে। করম প্রথম বৃক্ষশাখা পুঁতে এই পুজোর প্রচলন করেছিল। আমরা চিরাচরিত রীতি মেনে এই পুজো করে আসছি।”
নওয়াপাড়ার বাসিন্দা সুভাষ চন্দ্র মুরমু ও সহ পুরোহিত নন্দলাল সর্দার জানালেন, এই বছর করোনা অতিমারির জন্য অনেক স্থানেই এই উৎসব পালন করা হচ্ছে না। তবে এই গ্রামে স্বল্প আয়োজনে যথেষ্ট সচেতনতার সঙ্গে এই উৎসব অনুষ্ঠিত করা হয়েছে।