শেষ হতে যাচ্ছে ৪৪তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা ২০২০ (ভিডিও সহ)

Advertisement
Capture2

সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতার বইমেলা পূর্ব এশিয়ার মধ্যে প্রাচীনতম। ১৯৭৬ সালের ৩ মার্চ মাত্র ৫৪টি স্টল নিয়ে যে মেলার সূচনা হয়েছিল এবছর ৪৪তম কলকাতা বইমেলায় এখনও পর্যন্ত স্টলের সংখ্যা সাড়ে ৫০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে সুবৃহৎ এই বই মেলায় প্রবেশের জন্য নটি তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। যার প্রতিটির থিম আলাদা।

     কলকাতা বইমেলায় প্রতিবেশী দেশ ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে বইপ্রেমী মানুষ বিপুল সংখ্যায় ভিড় জমিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পাবলিশার্স ও বুকসেলার্স গিল্ডের উদ্যোগে বইমেলার আয়োজন করা হয়েছে কলকাতার সল্টলেক করুণাময়ী সেন্ট্রাল পার্ক মেলা প্রাঙ্গণে।
     এবারের বইমেলা শুরু হয়েছে ২৯ জানুয়ারি চলবে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। রাশিয়ার কনসাল জেনারেলের উপস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বইমেলার শুভ উদ্বোধন করেন। প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বইমেলা খোলা থাকছে। মেলায় প্রবেশের জন্য কোন প্রবেশ মূল্য নেই। উপরন্তু ১০০০ টাকার বেশি বই কিনলে তার ওপর রয়েছে লাকি ড্রয়ের হাতছানি।
     কলকাতার বইপাড়ার অভিজাত প্রকাশনা আনন্দ পাবলিশার্স, দেজ পাবলিশিং, মিত্র ঘোষ, পারুল বই, আজকাল, পত্রভারতী, গাংচিল, প্রভৃতি সংস্থা যেমন মেলা প্রাঙ্গণ আলো করে আছে, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের নানা সরকারি ও বেসরকারি ছোট-বড় প্রকাশনা সংস্থার স্টল স্থান পেয়েছে এবারের বইমেলায়।
     প্রতিবছরের মতো ভারতের বিভিন্ন রাজ্যগুলি থেকে এসেছে বিভিন্ন ভাষার প্রকাশনা সংস্থা গুলি। তাছাড়া বিদেশ থেকে এসেছে নেপাল, বাংলাদেশ, পেরু, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, গ্রেট ব্রিটেন, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ফ্রান্স সহ ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলি।
     এবারে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার মূল ভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে রাশিয়া। নবগঠিত রাশিয়ার স্টলে রয়েছে নতুন যুগের বিপুল বইয়ের সম্ভার। তবে সোভিয়েত আমলের সেই সস্তার বইয়ের বিপুল সম্ভার আর নেই।
     আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরা থেকে এসেছে সেখানকার অন্যতম বিখ্যাত বাংলা প্রকাশনা সংস্থা জ্ঞান বিচিত্রা। প্রায় এক হাজারের বেশি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল বইয়ের সমাবেশ ঘটেছে তাদের স্টলে বইমেলাকে কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যক লোকের সমাবেশ হয় প্রতিদিন। এত মানুষের জন্য সুষ্ঠু আয়োজন করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন মেলাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করার। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে প্রচুর পুলিশি ব্যবস্থা। বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য পরিস্রুত পানীয় জলের পাউচ প্যাকেটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আছে পরিচ্ছন্ন টয়লেটের ব্যবস্থা।
     ১৯৯৭ সালে অগ্নিসংযোগের ফলে বইমেলা সম্পূর্ণরূপে ভষ্মিভূত হয়। সেই অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে মেলায় খাবার-দাবারের স্টলগুলিকে বইয়ের স্টল থেকে যথেষ্ট দূরত্বে, মেলার দুই প্রান্তে ফুডকোর্ট তৈরি করা হয়েছেমেলায় ধূমপান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্লকগুলিতে রাখা হয়েছে ফায়ার এক্সটিংগুইশার ও অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা। তাছাড়া সদা প্রস্তুত রয়েছে ফায়ার ব্রিগেড।
     মেলায় ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ল ব্যতিক্রমী বইয়ের প্রকাশনা সংস্থা পারুল বইয়ের স্টল। এরা নিয়ে এসেছেন ভারতের ভাস্কর্য, মধ্যযুগে বাঙালি শব্দকোষ, সুবর্ণ সংগ্রহ বিদ্যাসাগর, বর্ণময় নজরুল, রঙ্গলাল প্রভৃতির মত মূল্যবান গবেষণা গ্রন্থ। এখান থেকে প্রকাশিত হয়েছে জনপ্রিয় কবি রেহান কৌশিকের বেশ কয়েকটি সুদৃশ্য কবিতার বই
     এবার মুজিবর রহমানের শতবর্ষ ও বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে তাই শুধু বাংলাদেশের জন্যই একটি বৃহৎ প্যাভিলিয়ন নির্মিত হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ থেকে আসা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা সংস্থা তাদের বিপুল বৈচিত্র্যময় বইয়ের সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছেন।
     বাংলাদেশের হল ছাড়াও নবনীতা দেব সেন ও গিরিশ কর্নাডের নামাঙ্কিত হলগুলোতে ভিন্ন রাজ্য ও বিদেশ থেকে আসা ইংরেজি হিন্দি ও বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার প্রকাশনা সংস্থার স্টলগুলি স্থান পেয়েছে।
     সচরাচর যেসব প্রকাশনারগুলির বই সংগ্রহ করা খুবই মুশকিল হয় যেমন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতাএশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রভৃতি সংস্থার স্টলগুলোতে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভিড় জমিয়েছেন।
     মেলা ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ে নানা দৃশ্য কোথাও শিল্পী ফুটিয়ে তুলছেন তার দেশের বহুমাত্রিক সংস্কৃতি, কেউবা তার অসুস্থ বইপ্রেমী মাকে নিয়ে ভিড় এড়াতে দুপুরদুপুর হাজির হয়েছেন মেলা ঘুরতে।
     ব্রিটিশ কাউন্সিল যেমন বিপুল বইয়ের সম্ভার হাজির করেছে, তেমনি সেখানে বসেছে তাৎক্ষণিক কুইজের আসর উত্তর দিতে পারলেই মিলবে হাতে হাতে পুরস্কার। লিটল ম্যাগাজিনের জন্য আলাদা স্টল করা হয়েছে। সেখানে চলছে উদ্যমী তরুণ কবি সাহিত্যিকদের আড্ডা।
     বইমেলা হল লেখক-পাঠকের মিলনক্ষেত্র। প্রিয় লেখকের বইটিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে নেওয়ার তাগিদ বিভিন্ন স্টলে দেখা গেল। রাতের বইমেলা আরও আকর্ষণীয় আরও মোহময়ী। চারিদিকে শুধু মানুষের ভিড়। অফিস ও স্কুল-কলেজ ফেরতা বিপুল সংখ্যক মানুষ ভিড় করেন বই মেলায়। আলোকমালায় সুসজ্জিত স্টলগুলিও তাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। ক্ষ্যাপার পরশপাথর খোঁজার মতো ঈপ্সিত বইটি সন্ধানে ঘুরে বেড়ান বই বুভুক্ষু মানুষ।
     রাতের মেলাকে জমজমাট করে রাখে তরুণ ছেলের দল। সারাদিন মেলায় টোটো চক্কর কেটে এক জায়গায় জমায়েত হয়ে গিটার হাতে চলে সমবেতবৃন্দ গান। চলতে চলতে থেমে যেতে হয় সেই তরুণ উদাত্ত কণ্ঠের আহ্বানে।
     সব মিলিয়ে কলকাতার বইমেলা সর্ব অর্থেই ব্যতিক্রমী। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের শ্রেষ্ঠ পার্বণ। এমন উষ্ণ প্রাণের স্পন্দন দিল্লির আন্তর্জাতিক বইমেলাতেও দেখতে পাওয়া যায়নিকলকাতার আন্তর্জাতিক বইমেলা অবশ্যই আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার।
Advertisement
Previous articleমূয়রাক্ষী নদী তীরবর্তী অঞ্চলে আলু চাষ করে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা
Next articleদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here