তবে আর্থিক সঙ্গতি এখানে বড্ড প্রয়োজন। নাহলে বর্তমান সময়ে কোনও উদ্দেশ্যই যে পূরণ হবার নয়। নারায়ণ হাঁসদা কখনও অর্থ গ্রহণ করেন না তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে। তবে তাঁর এই উদ্যোগ পূরণ হচ্ছে কীভাবে? জানা গেল, নারায়ণ বাবুর নিজস্ব দুই বিঘা জমি রয়েছে। তাতেই সারা বছর খেটে ফসল ফলাতে হয় স্বামী ও স্ত্রী দুজনকে। যখন চাষ থাকে না, দিনমজুরের কাজ করেন দুজনে। আর অবসরে চলে এই ‘শিক্ষাদান পর্ব’।

বিজয় ঘোষাল : বীরভূম জেলার লাভপুরের কুয়ে নদীর গাঁ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম, কালিকাপুরডাঙা। গ্রামটির প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ কৃষি বা দিনমজুর কাজের সঙ্গে যুক্ত। গ্রামে প্রবেশ করলে মাঝে মধ্যেই শুনতে পাওয়া যায় ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের উচ্চারিত ‘অ-আ-ক-খ’ বা ‘এ-বি-সি-ডি’। কখনও বা শুনতে পাওয়া যাবে কিশোর-কিশোরীদের পাঠ্যাংশের কোনও পরিচিত গল্প বা কবিতার পঠন। যারা পড়ছে তাদের প্রত্যেকের বয়স ৫ থেকে ১৪। এদের কেউ পড়ছে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে অথবা কেউ হাইস্কুলে। এখানে এরা সংখ্যায় প্রায় ৪০ জন।
যদিও শিক্ষাক্ষেত্রগুলি এখন প্রায় সবই বন্ধ। কিন্তু কালিকাপুরডাঙার এই ছোট্ট শিক্ষাক্ষেত্রটি চলতেই থাকে দিনের পর দিন। উদ্দেশ্য, কোভিডের কারণে যেন গ্রামের দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া থেমে না যায়। আর যিনি উৎসাহ, উদ্যম ও নিঃস্বার্থে এই শিক্ষাক্ষেত্রটি পরিচালনা করছেন, তিনি এই গ্রামেরই যুবক, নাম নারায়ণ হাঁসদা।
জানা গেল, এই প্রায় ৪০ জন ছেলে-মেয়েকে পড়াতে নারায়ণ বাবু কোনও অর্থ গ্রহণ করেন না। কিন্তু কেন? তিনি জানালেন, নিজে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। চেষ্টা করেও কোনও উপযুক্ত চাকরি জোটেনি তাঁর। তবে নিরাশ হননি। এখন প্রত্যন্ত এই গ্রামটির দরিদ্র পরিবারগুলির ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। আর এটাই তাঁর এখন একমাত্র লক্ষ্য।
তিনি আরও জানালেন, একমাত্র নিজস্ব ভালো লাগা থেকে তার এই উদ্যোগ। সকাল-দুপুর দুবেলা পড়ান তিনি। অনেক ছেলে-মেয়ে নিজের ইচ্ছায় পড়তে আসে তাঁর কাছে। শুধু স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীরাই নয়, তাঁর কাছে পাঠ গ্রহন করতে আসে আমোদপুর এমনকি মল্লারপুরের মতো দূরবর্তী ছেলে-মেয়েরাও। দূরবর্তী এই ছেলে-মেয়েদের জন্য থাকে ভরপেট খাওয়ারও ব্যবস্থা। আর এই ব্যবস্থা করেন নারায়ণ বাবু নিজে ও তাঁর স্ত্রী বকুল দেবী।
স্বামীর এহেন কাজে অবশ্য কোনও দিনই কোনওরকম আপত্তি করেননি স্ত্রী বকুল দেবী। বরং স্বামীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এই সমস্ত পড়ুয়াদের শিক্ষিত করে তোলার কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন তিনিও। পড়ুয়াদের মধ্যে অনেকেই আবার থেকে যান তাঁদেরই বাড়িতে। তাঁদেরও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি।
তবে আর্থিক সঙ্গতি এখানে বড্ড প্রয়োজন। নাহলে বর্তমান সময়ে কোনও উদ্দেশ্যই যে পূরণ হবার নয়। নারায়ণ হাঁসদা কখনও অর্থ গ্রহণ করেন না তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে। তবে তাঁর এই উদ্যোগ পূরণ হচ্ছে কীভাবে? জানা গেল, নারায়ণ বাবুর নিজস্ব দুই বিঘা জমি রয়েছে। তাতেই সারা বছর খেটে ফসল ফলাতে হয় স্বামী ও স্ত্রী দুজনকে। যখন চাষ থাকে না, দিনমজুরের কাজ করেন দুজনে। আর অবসরে চলে এই ‘শিক্ষাদান পর্ব’।
নারায়ণ বাবুর এই উদ্দেশ্য আজকের নয়, বহুদিন ধরেই তাঁর এই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তিনি স্থির রয়েছেন। মাধ্যমিক পাশ করার পরই তিনি স্থির করে নিয়েছিলেন, গ্রামের দরিদ্র ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। এই চেষ্টা তাঁর আজও চলমান। তাঁর বহু ছাত্র ইতিমধ্যে উচ্চশিক্ষা নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর এই দুঃসাহসী কাজের জন্য লাভপুরের ‘দিশারী সংস্কৃতিক চক্র’ চলতি বছর অর্থাৎ ২০২১-এর শিক্ষকদিবসের অনুষ্ঠানে তাঁকে স্মারক যোগে সম্মাননা দিয়েছে।
দেশে ক্রমশই বড়ো হচ্ছে ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য। ধনী পরিবারের অধিকাংশ ছেলে-মেয়েরা অর্থের জোগানে সুযোগ পাচ্ছে বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে। সেখানে পিছিয়ে থাকছে দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা। এক্ষেত্রে আদিবাসী তরুণ নারায়ণ হাঁসদার এই দুঃসাহসী উদ্যোগ স্বতন্ত্র বার্তা দেবে সমাজের কাছে।