Advertisement
শান্তিনিকেতন বৃক্ষরোপণের ইতিহাস চর্চা করলে জানা যায় যে, ঋতু উৎসব রূপে রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে এই উৎসবের সূচনা করেন ১৯২৮ সালে, গৌরপ্রাঙ্গণে সিংহসদনের সামনে একটি বকুল গাছ রোপণের মাধ্যমে। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবছরে বৃক্ষরোপণ হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯৪২ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন স্মরণে শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণের একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক হয়। – ছবি : সংগৃহীত
|
অতনু কুমার সিংহ : বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ প্রবর্তনের (১৪ জুলাই ১৯২৮) ২২ বছর পর ১৯৫০ সালে ভারত সরকার বনমহোৎসব আরম্ভ করে। বৃক্ষরোপণ যে একটা উৎসব হতে পারে রবীন্দ্রনাথ তা প্রত্যক্ষ দেখেছিলেন বিদেশে। রবীন্দ্রনাথ জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে প্রথম বৃক্ষরোপণ উৎসব প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ স্থির করলেন একটা আনন্দ উৎসবের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বৃক্ষরোপণ প্রথা গ্রামে গ্রামে চালু করবেন। …মহা আড়ম্বরে বৃক্ষরোপণোৎসবের অনুষ্ঠান হ’ল। উৎসবের অঙ্গ ছিল তরু শিশুর সঙ্গে বালিকাদের শোভাযাত্রা- সুন্দরী বালিকারা সুপরিচ্ছন্ন হয়ে শাঁক বাজাতে বাজাতে গান গাইতে গাইতে গাছের সঙ্গে যজ্ঞক্ষেত্রে এল’। এই রকম এক নৃত্যশালা মেয়েদের উৎসব সম্ভার নিয়ে শোভাযাত্রা করতে রবীন্দ্রনাথ বালিদ্বীপে দেখেছিলেন। ভারতীয় পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ এর নতুন রূপ দেন। (রবীন্দ্রজীবনকথা, পৃ. ২১৪)
১৯১৬ সালে জাপান সফরের সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধু ওকাকুরার সমাধির কাছে একটি ফারগাছ ও ওই বছরই আমেরিকা সফরকালে সেখানকার ক্লেভল্যাণ্ড শহরবাসীর অনুরোধে সেক্সপীয়র উদ্যানে একটি আইভিলতা রোপণ করেন। ৯ জুন ১৯২৬, ইতালিতে শান্তিকানন নামে ছোট ছেলে-মেয়েদের এক বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে দিয়ে একটি জলপাই গাছ রোপণ করান। নির্মলকুমারী মহলানবিশের লেখা ‘কবির সঙ্গে য়ুরোপে’ বইটি (পৃ. ২১৬) থেকে জানা যায়, ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ হাঙ্গেরির ব্যালাতন ফুরেজে বৃক্ষরোপণ করেছিলেন। জাপানে থাকাকালীন জাপানবাসীর অনুরোধে একটি প্রস্তর ফলকে খোদাই করার জন্য একতি কবিতা লিখে দেন, ‘হে তরু, এ ধরাতলে রহিব না যবে, / সেদিন বসন্তে নব পল্লবে পল্লবে / তোমার মর্মর ধ্বনি পথিকেরে কবে- / ভালবেসেছিল কবি বেঁচেছিল যবে’।
শান্তিনিকেতন সৃষ্টির পর রবীন্দ্রনাথ আশ্রমে একের পর এক উৎসবের সূচনা করেছেন। সেই ধারা অনুসারে বর্ষাকালে বর্ষা উৎসবের সাথে তিনি যুক্ত করেন আরও দুটি উৎসব- একটি বৃক্ষরোপণ (২১ জুলাই ১৯২৮) এবং অপরটি হলকর্ষণ (২২ জুলাই ১৯২৮)। প্রথমদিকে শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণের নির্দিষ্ট কোনও দিন ছিল না। শান্তিনিকেতনে এই উৎসবের সূত্রপাত হয়েছিল ১৩৩২ বঙ্গাব্দে (ইংরেজি ১৯২৫) রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের অঙ্গ হিসেবে, উত্তরায়ণের উত্তর দিকে ‘পঞ্চবটী’ (অশ্বত্থ, বিল্ব অর্থাৎ বেল, বট, ধাত্রী অর্থাৎ আমলকি ও অশোক) বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়ে। বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের সদ্য রচিত গান ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও’ গাওয়া হয়। (স্মরণঃ বাইশে শ্রাবণ, পৃ. ১৪২)
শান্তিনিকেতন বৃক্ষরোপণের ইতিহাস চর্চা করলে জানা যায় যে, ঋতু উৎসব রূপে রবীন্দ্রনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে এই উৎসবের সূচনা করেন ১৯২৮ সালে, গৌরপ্রাঙ্গণে সিংহসদনের সামনে একটি বকুল গাছ রোপণের মাধ্যমে। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুবছরে বৃক্ষরোপণ হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯৪২ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন স্মরণে শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণের একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক হয়। বিশ্বভারতী নিউজ (সেপ্টেম্বর ১৯৪২) থেকে জানা যায়, ‘to commemorate the death anniversary of Gurudev by holding the Viksharopana ceremony in asrama as well as in the surrounding village during the month’।
২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন, আর ওই দিনই শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ- বিরহ ও নবজন্মের সমন্বিত বানীতে, একই পরিধির ভিতর, ২২শে শ্রাবণের দুইটি পরিপূরক অনুষ্ঠান। ২২ শ্রাবণ ১৪০৬, উপাসনাগৃহে সকালের উপাসনায় বিশ্বভারতীর তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক দিলীপকুমার সিংহ এই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘গুরুদেবের মৃত্যুদিনটিকেই আমরা বৃক্ষরোপণের দিন বলে ধার্য করে নিয়েছি। আশ্রমে আজ মরুবিজয়ের সম্ভব হয়েছে’।
উৎসবের বর্তমান রীতি অনুসারে বিশ্বভারতী কর্মিমন্ডলী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সহযোগিতায় শান্তিনিকেতন আশ্রমের মধ্যে নবনির্মিত ভবন বা বাড়ি অথবা কোনও ফাঁকা স্থানকে বৃক্ষরোপণের জন্য নির্বাচন করে। উদ্যান বিভাগের পক্ষ থেকে গাছ নির্বাচন, গাছ লাগানোর জন্য গর্ত খোঁড়া ইত্যাদি ও কলাভবনের পক্ষ থেকে গর্তের চারপাশে আলপনা দিয়ে সহায়তা করা হয়। পাঠভবন, শিক্ষাসত্র ও সংগীতভবন সহ বিশ্বভারতীর অন্যান্য বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের পাঠক্রমের অঙ্গ হিসেবে প্রায় দু’সপ্তাহ আগে থেকে শুরু করে দেয় নাচ-গানের মহড়া।
বৃক্ষরোপণের দিন বিকেল ৪টেয় শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রায় একটি সুসজ্জিত দোলা করে বৃক্ষশিশুকে বহন করে নিয়ে যান ছয়জন ছাত্র, যাদের দুইজন ছত্রবাহক হিসেবে থাকেন ও বাকি চারজন কাঁধে করে কাঠের তৈরি একটি পালকি বহন করেন। বেতনির্মিত দুটি বড় ছাতা কাঁঠালপাতা ও ফুল দিয়ে সাজিয়ে শিশুবৃক্ষের উপরে ধরা হয়। শোভাযাত্রার সামনে ও পিছনে থাকে নাচের দল- ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও’ গানের সাথে সাথে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রীর দল উৎসবমঞ্চের দিকে এগিয়ে চলেন। অংশগ্রহণকারী ছাত্ররা হলুদ বা সাদা পাঞ্জাবির সাথে সাদা পাজামা বা ধুতি পরেন, মহিলারা পরেন হলুদ শাড়ি।
শোভাযাত্রা উৎসবপ্রাঙ্গণে পৌঁছলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সভাপতি ও আমন্ত্রিত প্রধান অতিথিকে বরণ করে নেওয়া হয়। এরপর হয় মঞ্চে বসে থাকা পঞ্চভূতের আবাহন। এদের পরনের পাঞ্জাবি ও শাড়ির রঙ, মাথার মুকুটের নক্সা ও কপালে আঁকা টিপ পঞ্চভূতের একেকটি প্রতীক- ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। এদের প্রত্যেকের সঙ্গে থাকা এক-একজন ছাত্র-ছাত্রী পঞ্চভূতের প্রশস্তি আবৃত্তি করেন। পঞ্চকন্যার শাড়ির রঙ যথাক্রমে কমলা, সবুজ, হালকা নীল, হলুদ ও লাল। শঙ্খধ্বনির মধ্যে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত প্রধান অতিথি চতুর্দোলা থেকে নিয়ে বৃক্ষশিশুকে গর্তের মধ্যে রোপণ করেন, পঞ্চকন্যার হাতে থাকা পাত্র থেকে জল, হাতপাখা দিয়ে হাওয়া, ধূপদানির ধূপ প্রদর্শন, মাটির তাল শিশুবৃক্ষের উপর অর্পণ করেন। অনুষ্ঠানে বেদমন্ত্র পাঠ করা হয়, ‘আয় আমাদের অঙ্গনে’, ‘কোন পুরাতন প্রাণের টানে’ ইত্যাদি বেশ কিছু গান ও নাচ উপস্থাপিত হয়। পরিশেষে ‘বনবানী’ কাব্য থেকে ‘মাঙ্গলিক’ কবিতাটি আবৃত্তি করা হয়।
বিগত ২০১৫ সাল থেকে শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণের তালিকাটি হল- ২০১৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুগত মার্জিত নবনির্মিত ভাষাভবন প্রাঙ্গণে বকুল গাছ, ২০১৬ সালে উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চিরন্তন চ্যাটার্জী মাধবীবিতান সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তমাল গাছ, ২০১৭ সালে জাপানের কনস্যুলেট জেনারেল ইয়াশিকো তানাকা নবনির্মিত কলা-সঙ্গীত ভবনে পারুল গাছ, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের ডেপুটি-হাইকমিশনার তৌফিক হাসান নবনির্মিত বাংলাদেশভবনে ক্যাশিয়া গাছ ও ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বিবেক দেবরায় সন্তোষালয় প্রাঙ্গণে রুদ্রাক্ষ গাছ রোপন করেন। বর্তমান ২০২০ সালে, বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমনের আবহে অনুষ্ঠিত বৃক্ষরোপণে বিশ্বভারতীর রসায়ন বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক দীপক আচার্য আম্রকুঞ্জে একটি আম গাছ রোপণ করেন। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে রাজ্য সরকার এবং জেলা প্রশাসন যে লকডাউন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, সেই আবহে বর্তমান বছরে যথাযথ দূরত্ববিধি অনুসরণ করে নাচের শোভাযাত্রা বা কোনওরকম বিশেষ আড়ম্বর ছাড়াই বিকেলের পরিবর্তে বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠিত হয় দুপুর ১২টায়।
১৯৩৮ সালে (১৭ ভাদ্র ১৩৪৫) শ্রীনিকেতনে বৃক্ষরোপণ ও হলকর্ষণ উৎসবের ভাষণে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষ গৃধ্নুভাবে প্রকৃতিকে গ্রহণ করেছে; প্রকৃতির সহজ দানে কুলোয়নি, তাই সে নির্মমভাবে বনকে নির্মূল করেছে। তার ফলে আবার মরুভূমিকে ফিরিয়ে আনবার উদ্যোগ হয়েছে। ভূমির ক্রমিক ক্ষয়ে এই যে বোলপুরে ডাঙার কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে, বিনাশ অগ্রসর হয়ে এসেছে— এক সময়ে এর এমন দশা ছিল না; এখানে ছিল অরণ্য, সে পৃথিবীকে রক্ষা করেছে ধ্বংসের হাত থেকে, তার ফল মূল খেয়ে মানুষ বেঁচেছে। সেই অরণ্য নষ্ট হওয়ায় এখন বিপদ আসন্ন। সে বিপদ থেকে রক্ষা পেতে হলে আবার আমাদের আহ্বান করতে হবে সেই বনদাত্রী বনলক্ষীকে, আবার তিনি রক্ষা করুন এই ভূমিকে, দিন তাঁর ফল, দিন তাঁর ছায়া’।
(লেখক বিশ্বভারতীর পল্লী শিক্ষা ভবন গ্রন্থাগারের কর্মি এবং পল্লী সম্প্রসারণ কেন্দ্রের গবেষক)
Advertisement