গরু চিকিৎসায় এক সময় ব্যবহার করা ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রফেন ওষুধগুলিকে শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ বলেই চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এই ওষুধ ব্যবহার করা মাংস খেয়ে মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কিডনি বিকল হয়ে যাচ্ছে শকুন-এর। এছাড়াও ভাগাড়ের অভাব ও প্রজননের নিশ্চিত স্থানাভাবের জন্যেও শকুনের বিলুপ্তি ঘটছে বাংলার আকাশ থেকে।

অনলাইন পেপার : এই বিশ্বে প্রায় ৬০ লক্ষ বছর ধরে শকুন-এর বসবাস চললেও, অতি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে এই কদাকার পাখিটি। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে অতি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে শুরু করেছে এই পাখিটির সংখ্যা। এক সময় বঙ্গদেশের গ্রামগুলিতে শকুন-এর যাতায়াত ছিল যথেষ্ট পরিমাণে। এদেরকে নিয়ে নানান অশুভ কাহিনীও রচিত হয়েছে সেসময়। কিন্তু আশ্চর্যরকমভাবে এরা হারিয়ে যেতে শুরু করেছে বঙ্গদেশের বুক থেকে।
‘ঝাড়ুদার পাখি’-দের মধ্যে অন্যতম ছিল এই শকুন। সেসময় গ্রাম বা শহরগুলির প্রান্তদেশে থাকত ‘পশুভাগাড়’। মৃত পশুদের দেহাবশেষ সেখানে ফেলে দেওয়া হত। দুর্গন্ধ ছড়াত সমগ্র অঞ্চল জুড়ে। আশ্চর্যরকমভাবে এগুলিই ছিল শকুন-এর খাবার। মুহূর্তের মধ্যে সাবাড় করে ফেলত মৃত পশুগুলিকে। দুর্গন্ধ ছড়ানো ও রোগ সংক্রমণের হাত থেকে বেঁচে যেত পরিবেশ। যদিও সেসব এখন অতীত। কাক ছাড়া ‘ঝাড়ুদার পাখি’-দের কাউকেই আর বিশেষ দেখতে পাওয়া যায় না বঙ্গদেশের অঞ্চলগুলিতে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিবিসি সংবাদ মাধ্যমের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, কোনও একটি প্রাণীর সংখ্যা যদি তার মোট সংখ্যার ৯০ শতাংশ কমে যায় তবে সেই প্রাণীটিকে লাল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখানে শকুন-কেও লাল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কারণ বাংলার আকাশ থেকে অতি দ্রুতগতিতে হারিয়ে যাচ্ছে এই পাখিটি। ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৭০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে শকুনের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ হাজার। পরে দেশ জুড়ে শুমারি চলাকালিন দেখা গিয়েছে ২০০৮-০৯ সালে ১৯৭২টি, ২০১১-১২ সালে ৮১৬টি ও ২০১৪ সালে মাত্র ২৬০টি শকুন অবশিষ্ট রয়েছে। এই ২৬০টির সবগুলিই বাংলা শকুন। বাংলাদেশের সিলেট ও সুন্দরবনের কয়েকটি অঞ্চলে এখন কোনও রকমে টিকে রয়েছে এই শকুন-গুলি।
বিশ্বে ১৮ প্রজাতির শকুন থাকলেও বাংলায় রয়েছে মাত্র ৬ প্রজাতি। তার মধ্যে বাংলা শকুন, রাজ শকুন, গ্রিফন শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরুঠোঁট শকুন অন্যতম। এখন শুধুই বাংলা শকুন অবশিষ্ট রয়েছে বাংলাদেশে। রাজ শকুন বহু বছর ধরেই অজ্ঞাত এখানে। তবে হিমালয়ী শকুন ও গ্রিফন শকুন মাঝে মধ্যে এসে হাজির হয় পরিযায়ী বেশে। অবশ্য কোনও কোনও বছর তাদেরও আর দেখতে পাওয়া যায় না।
গরু চিকিৎসায় এক সময় ব্যবহার করা ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রফেন ওষুধগুলিকে শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ বলেই চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এই ওষুধ ব্যবহার করা মাংস খেয়ে মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কিডনি বিকল হয়ে যাচ্ছে শকুন-এর। এছাড়াও ভাগাড়ের অভাব ও প্রজননের নিশ্চিত স্থানাভাবের জন্যেও শকুনের বিলুপ্তি ঘটছে বাংলার আকাশ থেকে।
যদিও বাংলাদেশের কোথাও শকুন সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে আইইউসিএন-কে সঙ্গে নিয়ে বেশ কতকগুলি উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির সরকার। বিবিসি-র ওই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১০ সালে ডাইক্লোফেনাক ও ২০১৭ সালে কেটোপ্রফেন জাতীয় ওষুধগুলি নিষিদ্ধ করেছে দেশটি। ২০১২ সালে আইন করে শকুন-কে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রেখেছে। ২০১৩ সালে একটি শকুন সংরক্ষণ কমিটিও গঠন করেছে। এছাড়াও ২০১৬ সালে ২০১৬-২০২৫ সালের একটি ১০ বছরের শকুন সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০১৪ সালে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম এবং ঢাকা, খুলনা ও বরিশালকে নিয়ে গঠিত দুটি অঞ্চলকে শকুনের নিরাপদ স্থল হিসাবে ঘোষণা করেছে।
যদিও বাংলাদেশে ২০১৪ সালের পর শকুন গণনায় আর কোনও শুমারি হয়নি। চলতি বছর শুরু হয়েছে নতুন করে শুমারি। চলবে মার্চ পর্যন্ত। এখন দেখার সেই শুমারিতে শকুনের সংখ্যার পরিবর্তন কোনও দিকে যায়।