Advertisement
এক সময়ের শৈশবের খেলাগুলি এখন প্রায় লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সেই খেলাগুলিকে রীতিমতো গবেষণা করে লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক অর্ঘ্য ঘোষ তার “লুপ্তপ্রায় খেলা”-র বইয়ে। বইটি এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে গ্রাম-বাংলার বুকে। পরবর্তী সময়ে বইটি গবেষণার প্রয়োজনেও অদ্বিতীয় হয়ে উঠবে। – ছবি : বিজয় ঘোষাল
|
সুজয় ঘোষাল : সমস্ত কিছুর সঙ্গে মানুষের শৈশবও বদলে যাচ্ছে অতি দ্রুত। বর্তমান প্রজন্মের থেকে তাই অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছে তিন বা চার দশক পূর্বের শৈশব। এই দুই শৈশবের মধ্যে পার্থক্য ধরা পড়ছে এখন সুস্পষ্টভাবে। স্পষ্টতা দেখা দিয়েছে গ্রামীণ জীবনের অঙ্গেও। ২৫-৩০ বছর আগেও গ্রাম-বাংলার পরিবেশে টেলিভিশন নামক ‘বোকা বাক্স’-টির সহজলভ্যতা ছিল না। হয়তো গোটা গ্রাম জুড়ে একটি বা দুটি টেলিভিশনের প্রাচুর্য ছিল। আর ইলেকট্রনিক খেলনা সামগ্রী তখন ছিল অনেকটাই দূরে। তাই স্বাভাবিকভাবেই শৈশবের দিনগুলিতে দলবদ্ধ খেলাগুলিই ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের শৈশব ‘দলবদ্ধ’ ব্যাপারটাকেই গ্রহণ করতে নারাজ। কারণ সহজলভ্য কম্পিউটার বা মোবাইল প্রযুক্তি তাকে বাকিদের থেকে আলাদা করতে মদত জুগিয়েছে।
দলবদ্ধ খেলাগুলি ক্রমশ হারিয়ে যেতে শুরু করেছে বলতে গেলে মোবাইল ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ার পর থেকেই। টেলিভিশনকেও অনেকে দোষের ভাগীদার করতে চান। কিন্তু টেলিভিশনের যুগেও কিছুটা দলবদ্ধতা ছিল। পরে ক্রমশ বিলুপ্ত হতে থাকে। আর এরই সঙ্গে হারিয়ে যেতে থাকে এক সময়কার প্রিয় খেলাগুলি। যেগুলি তখনকার সময়ে ছিল শৈশব বিনোদনের অদ্বিতীয় মাধ্যম। নিয়ম করেই প্রতিদিনের খেলার মাঠগুলি সেজে উঠত রঙিন শৈশবের ছোঁয়ায়। এখন সেই খেলার মাঠগুলিই স্থান পেয়েছে ঘরের কোণে, এন্ড্রোয়েড মোবাইলে, ‘পাবজি’ বা ‘ফ্রি ফায়ার’-এর দুনিয়ায়। আর অপরদিকে ক্রমশ হারিয়ে যেতে শুরু করেছে ‘লুকোচুরি’, ‘কানামাছি’, ‘কুমিরডাঙা’-র মতো জনপ্রিয় খেলাগুলি।
তখনকার শৈশবের হারিয়ে যাওয়া সেই খেলাগুলির তালিকা নেহাত কম বড়ো ছিল না। অবশেষে জনপ্রিয়তা হারিয়ে ক্রমশ ‘লুপ্তপ্রায় খেলা’-তে পরিণত তাকে হতেই হল। কিন্তু সেগুলিকে লিপিবদ্ধ করতে দোষ কোথায়! হারিয়ে যাওয়া সেই গ্রাম্য খেলাগুলিকে এবার এককভাবে লিপিবদ্ধ করার সাহস দেখিয়েছেন বীরভূম জেলার সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব তথা লেখক ও সাংবাদিক অর্ঘ্য ঘোষ।
এবছরের কোলকাতা বইমেলায় ‘অর্পিতা প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার বই “লুপ্তপ্রায় খেলা”। এই গ্রন্থে লেখক গ্রাম-বাংলার বুক থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাওয়া ৬০টি খেলাকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ওই খেলাগুলিকে খুঁজে বের করে, রীতিমতো গবেষণা করে সেগুলিকে লিপিবদ্ধ করা এখনকার সময়ে খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমে গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে, গ্রাম্য ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সেগুলিকে লিপিবদ্ধ করেছেন অতি নিখুঁতভাবে। আর সেই সঙ্গে খেলার রীতি, নিয়ম, খেলার সঙ্গে ব্যবহৃত সুপরিচিত শব্দ, বাক্য বা ছড়াগুলিকেও লিপিবদ্ধ করতে পেরেছেন।
বইটিতে প্রতিটি খেলার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে সেই খেলার আকর্ষণীয় ছবিও। যা দেখে পুরনো স্মৃতিগুলি মনে পড়াতে বাধ্য করাবে পাঠককে। এছাড়াও লেখক তাঁর সুচারু পর্যবেক্ষন ক্ষমতারও সঠিক প্রয়োগ করেছেন তার প্রত্যেকটির খেলার বিবরণে। খেলার নিয়ম-কানুনগুলিও অতি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন। যা পড়ে নতুন করে খেলাগুলি শুরু করতে বর্তমান শৈশবের কাছে কোনও অসুবিধারও সৃষ্টি করবে না।
ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, হকির মতো আন্তর্জাতিক মানের খেলাগুলিকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা হামেশায় নজরে পড়ে। কিন্তু গ্রাম-বাংলার লুকোচুরি, গুটির খেলা, মার্বেল খেলা, ডাংগুলি, তালাচাবি, চোর-পুলিশ, রুমাল চুরি, মাংস চুরি সহ বিভিন্ন লুপ্তপ্রায় খেলাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার কোনও উদ্যোগই সেভাবে নিতে দেখা যায় না। গ্রাম-বাংলার স্কুলগুলিতেও এই উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ে না। এই খেলাগুলি হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ অবশ্যই উদাসীনতা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে অভিভাবকরাও তাঁদের ছেলে-মেয়েদের উৎসাহ দিতে চান খুবই কম।
গ্রাম-বাংলার খোলা মাঠগুলি আজও ঠিকই পড়ে রয়েছে নিজের মতো করে। রোজ ছেলে-মেয়েরা ভিড়ও জমায় নিয়ম করে। কিন্তু সেকালের সেই খেলাগুলি আর খেলতে দেখা যায় না তাদের। লেখক অর্ঘ্য ঘোষ তার “লুপ্তপ্রায় খেলা”-র মধ্য দিয়ে মনে করিয়ে দিতে চাইলেন সেই হারিয়ে যাওয়া খেলাগুলিকে। তার এই বইটি খেলাগুলিকে আবার নতুন করে খেলতেও উৎসাহ যোগাবে যথেষ্ট। বইটিকে তাই গ্রাম-বাংলার নিজস্ব ‘খেলার ভাণ্ডার’ বললেও ভুল বলা হবে না। এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে চিরদিন। এমনকি পরবর্তী সময়ে গ্রাম-বাংলার ওপর গবেষণার প্রয়োজনেও এই বইটি হয়ে উঠবে অদ্বিতীয়।
Advertisement