Advertisement
বিজয় ঘোষাল : প্রায় দেড় মাস ধরে লকডাউন চলছে দেশ জুড়ে। করোনা সংক্রমণ রুখতে লকডাউনের বিকল্প কোনও পথের হদিশও মেলেনি এখনও পর্যন্ত। তাই কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে না পারায় দেশের অধিকাংশ মানুষই পেটের ভাত জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। তার ওপর কারও পেশা যদি লোকসমাগমের সংস্পর্শে হয়, তাহলে তাঁদের আরও কিছুদিন ভুগতে হতে পারে অর্থনৈতিক সমস্যায়। কারণ লকডাউন উঠলেও লোকসমাগম এড়িয়ে চলাটাই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করবেন গোটা দেশের মানুষ।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের সেই‘ছিনাথ’ বহুরূপীর কথা মনে আছে হয়তো অনেকের। বছরের বিভিন্ন সময়ে একাধিক ঢং–এ সেজে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মনোরঞ্জন করাটাই ছিল যার কাজ। এর বিনিময়ে সামান্য কিছু অর্থ উপার্জন হত তার। এখনকার সমাজে আজও কোনও রকমে টিকে রয়েছে সেই বহুরূপীর দল। বীরভূম জেলার লাভপুর ব্লকের বিষয়পুর এই রকমই একটি বহুরূপীর গ্রাম। এখানকার অধিকাংশ মানুষেরই পেশা হল বহুরূপী সাজা (অবশ্যই পেটের দায়ে)। এই লকডাউনের দিনগুলোতে দু-বেলা পেটের ভাত জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এখন তাঁদের।
লকডাউনের প্রথম দিন থেকেই ট্রেন-বাস সহ অন্য সমস্ত যানবাহন বন্ধ রয়েছে। তাই তাঁরা দূর-দূরান্তে যেতে পারছেন না বহুরূপী শিল্প দেখাতে। শুধু তাই নয়, পায়ে হেঁটে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়ার পথও এখন প্রায় রুদ্ধ। কেননা অন্য অনেক গ্রামের বাসিন্দারা যথেষ্ট সচেতন হয়ে বহিরাগতদের ঢুকতে দিচ্ছেন না তাঁদের এলাকায়। একপ্রকার সেজন্যেই আতান্তরেই দিনযাপন করতে হচ্ছে এই বহুরূপী শিল্পীদের। আগে গোটা দিন ট্রেন-বাসে ঘুরে যেখানে ২০০-২৫০ টাকা উর্পাজন হত। এখন সেই পথও প্রায় বন্ধ। তাই নিত্য পরিচিত বহুরূপী বেশভূষা ছেড়ে ঘরে বসে দিন কাটাতে হচ্ছে তাঁদের।
যদিও বিষয়পুরের এই বহুরূপী শিল্পীদের বেশ কয়েকজনকে লাভপুর থানার পক্ষ থেকে করোনা সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি প্রচারের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মাঝে মধ্যে। এই শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন সনাতন চৌধুরি, রাম চৌধুরি, কাজল চৌধুরি সহ আরও অনেকেই। পরে তাঁদের সাহায্যও করা হচ্ছে প্রশাসন থেকে। কিন্তু বাকি শিল্পীরা উদ্বেগের মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন।
বহুরূপী সূর্য চৌধুরি, উত্তম মন্ডলরা জানালেন, লকডাউনের সময় পেটে টান পড়েছে তাঁদের। সরকারি প্রচারের কাজে অন্য শিল্পীরা সুযোগ পেলেও অধিকাংশ শিল্পীরা পাননি। তাই অর্থ আসেনি তাঁদের ঘরে। ব্যক্তিগত সঞ্চয়ও এখন প্রায় শেষের দিকে সবার। রেশন থেকে পাওয়া চাল-ডাল দিয়েও হয়তো আরও কিছুদিন পেট চালানো যাবে। কিন্তু তারপর কী হবে?
প্রসঙ্গত, লাভপুরের এই গ্রামে প্রায় তিন পুরুষ ধরে বাস করছেন বহুরূপীরা। এঁদের অনেকেই এখন লোকশিল্পীর সরকারি প্রমাণপত্র পেয়েছেন। সংবাদপত্র ও লোকসংস্কৃতি গবেষকদের সৌজন্যে মাঝে মধ্যেই প্রচারের আলোয় আসেন তাঁরা। তখন তাঁদের নিয়ে ভাবতে বসেন সমাজের বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু লকডাউনের এই অসহায় দিনগুলিতে কেন কেউ আর তাঁদের নিয়ে নতুন করে ভাবছেন না, এটাই সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে এখন ওই বহুরূপীদের।
Advertisement