Advertisement
দেশে করোনা প্রবেশ করতেই বন্ধ করে দেওয়া হয় শান্তিনিকেতন। তারপর পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় চার মাস। এই চার মাসেই যেন অনেকটাই বদলে গিয়েছে শান্তিনিকেতনের চেনা ছবিগুলি। মাস পেরিয়ে যায়, ঋতুরও পরিবর্তন হয়, তবু যেন প্রাণ ফিরে আসে না এখানকার শান্ত পরিবেশে। এই স্তব্ধতার আবার কবে অবসান হবে, তাও এখন অনেকটাই অনিশ্চিত।
|
সুকুমার দাস : প্রায় দেড় শতকের শান্তিনিকেতনের গল্প শুনে বা দেখে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁরা কেউ মনে করতে পারছেন না, গত তিন-চার মাস ধরে চলা লকডাউনে শান্তিনিকেতনের এই ছবি আগে দেখেছেন কিনা। চিরকাল বিশ্বভারতীতে বছরে দুবার পঠন-পাঠন বন্ধ থাকে। এক শারদাবকাশ, দুই গরমের ছুটিতে। তখন কেবল পঠন-পাঠনই বন্ধ থাকে, কারণ আবাসিকরা বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু সার্বিক বিশ্বভারতীর কর্মকাণ্ডে কোনও ছেদ পড়ে না। পড়ুয়াদের সাময়িক অনুপস্থিতি নজরে এলেও, শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি একই রকম প্রাণবন্ত থাকে। গত মার্চে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষিত হলে, এই প্রাণোচ্ছল শান্তিনিকেতন যেন রূপ পরিবর্তন করেছে এক স্তব্ধ মরুভূমিতে! সোশ্যাল মিডিয়ার প্রায় প্রতিটি পরিসরে এর টুকরো টুকরো ছবি ধরা পড়ছে।
এখন প্রায় সর্বত্র যে অচেনা দৃশ্য চোখে পড়ে, তাহল রাস্তার দুপাশে অবাধে গছিয়ে ওঠা ঘাস। গৌরপ্রাঙ্গন, শালবীথি, বকুলবীথি, আম্রকুঞ্জ, এমনকি আশ্রম মাঠ সংলগ্ন ছোট-বড় লাল কাঁকড়ের রাস্তাগুলিরও একই চিত্র! গাছতলায় ক্লাস নেওয়ার স্থানগুলিও অনেকটা প্রাণস্পন্দন হারিয়ে ফেলেছে বলে মনে হয়। প্রতিদিন শয়ে শয়ে কচি-কাঁচাদের ভিড় আর কলতানে যে এখানকার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে থাকে, নিবিড় নিস্তব্ধতা তাকে গ্রাস করে বসেছে। এ চিত্র কোনওকালেই কেউ দেখেনি! গোটা বিশ্বজুড়ে করোনা-সংক্রমণের আশঙ্কা ও মৃত্যুভয় প্রতিটি মানুষেরই যেন আলোচনার কেন্দ্রে। তাই কোনওভাবে প্রাণে বেঁচে থাকা ছাড়া কারোর যেন আর কোনও কাজ নেই। শান্তিনিকেতন তো সেই মানচিত্রের বাইরে নয়! তাই পলকে পলকে সে প্রভাব এখানেও পড়েছে।
এখানকার বিরাট বিরাট গাছগুলি একমনে জপে চলছে নিস্তব্ধতার এক গভীর মন্ত্র! বকুলবীথি আর গৌরপ্রাঙ্গণের কাঁকড় মাটিকে ঢেকে দিয়েছে ফিকে গেরুয়া-সবুজের মস্ত এক গালিচা। আম্রকুঞ্জের ডালে ডালে থোকা থোকা আম ছিল। ছিল না গাছের তলায় কোনও কচিকাঁচা। তাই গাছগুলি যেন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দিন গুনছে তাদের জন্য। রঙ-বেরঙের পাখির ডাক আর ঝিঁঝিঁ পোকার দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে একটা চেনা সুর পাওয়া গেলেও, সেই সুরের মধ্যে কলতানের আনন্দ নেই। সকাল থেকে সাদা-হলুদ পড়ুয়াদের পিছন পিছন ঘুর ঘুর করত কত কুকুরছানা! কখন ওদেরকে প্রতিবেশীর মত কাছে ডেকে টিফিন খাওয়াবে, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে তাদের নানা নামে ডাকবে, তারা এই অপেক্ষায় থাকে। আজ ঘরে ঘরে কত ছেলে-মেয়ে তাদের কথা চিন্তা করে মনে কত কষ্ট পাচ্ছে কে জানে! পুরনো ঘন্টাতলা থেকে শালবীথি, সন্তোষালয় পর্যন্ত সর্বত্রই শুধু শুকনো পাতার মর্মরধ্বনির এক নিভৃত আর্তনাদ।
![]() |
ঘাসে আচ্ছন্ন উন্মুক্ত ক্লাসঘর |
ধীরে ধীরে বর্ষাও আবির্ভূত হয়ে গেল তার চির ছন্দের শান্তিনিকেতনে। চারিদিকে বকুল, শিরিষ, শিশু-দের কচিপাতার শোভা দেখার কেউ নেই। মাধবী-মালতীদের ফুলে ফুলে মৌমাছিদের গুনগুন গান শোনারও কেউ নেই! সন্ধ্যায় ফুলের গন্ধে মোহিত হওয়ার জন্য কেউ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে না। সবাই শুধু নিজের কাজ করে চলে, কোনও পারস্পরিক বোঝাপড়ার স্বাচ্ছন্দ্য নেই। এ শান্তিনিকেতন যেন চিরকালের চেনা সুর আর চেনা ছন্দ থেকে অনেক দূরে!
প্রায় সারাবছর ধরে পর্যটক আর পড়ুয়া-গবেষকদের ভিড় লেগে থাকে শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবন চত্বরে। সাধারণ মানুষ, দেশী-বিদেশী আর ছোট-বড় স্কুল-পড়ুয়ারা দলে দলে কবির স্মৃতি বিজড়িত মিউজিয়াম ও বাড়ি-গাড়ি দেখতে আসে দূর-দূরান্ত থেকে। গত চারমাস ধরে সেই রবীন্দ্রভবনের গেটে ভিড় জমে না, কাউন্টারের টিকিটের জন্য লম্বা লাইন নেই, ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাকও নেই। কেউ আবদার করে বলে না, “দাদা বাড়ির জন্য একটা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যান।” রাস্তার ওপার থেকে কেউ হাঁকে না, “দিদি ভালো দই রাবড়ী আছে, দেব নাকি?” আর সেই সাঁওতাল মেয়েরা কত উপকরণ দিয়ে হাতে গড়া সুন্দর সুন্দর কানের দুল, গলার হার কিংবা হাতের বালার পসরা সাজিয়ে মহিলা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে, তারাও আজ আর আসে না। টোটোবালাদের প্রতিনিয়ত হাঁকডাক, “স্টেশন যাবেন নাকি?”, “সোনাঝুড়ির হাট?”, কিংবা “আমার কুটীর?”- আর শোনা যায় না। নানা ব্রান্ডের আইসক্রিম নিয়ে কতজন বাচ্চাদের লোভ ধরাত, “এই বাচ্চা, একটা ঠান্ডা দেবো নাকি?”- এসব যেন সবাই ভুলতে বসেছে এই ক’মাসে।
![]() |
কলরবহীন দিনান্তিকা |
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, সারা বছর দেখা যেত এক গরীব চা-কফিওয়লাকে। তারও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যেন একমাত্র আশ্রয় ওই রবীন্দ্রভবনের মোড়। বেচারা খুব গরীব, কীভাবে যে সংসার চালাচ্ছে কে জানে! এদের সবার আজ ঘর থেকে বেরুনো মানা। কয়েকজন বয়স্ক লেখক-গবেষক প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে রবীন্দ্রভবনের লাইব্রেরি আর আর্কাইভে পড়াশুনা করতে আসেন। তাঁদের অনুপস্থিতি যেন বিধাতার দুর্লভ নির্দেশ, “ওরে, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে…”।
মন্দিরে বুধবারের সাপ্তাহিক উপাসনাও বেশ কিছু দিন বন্ধ রাখতে হয়ছিল। লকডাউন শিথিল হলে তা একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়। কিন্তু স্কুল বা কলেজ বিভাগগুলি বন্ধ থাকায় পড়ুয়াদের ভিড় নেই। মন্দিরের অপর প্রান্তে ভোর থেকেই প্রাতঃভ্রমণে ভিড় জমাতো। নানা অঙ্গ ভঙ্গিমায় অনেকে হেঁটে চলেন মাঠের ভিতরে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। লাল কাঁকড়ের হাঁটা পথের উপর সবুজ ঘাসের বেড়ে ওঠার অবাধ প্রশ্রয়ে, আজ পথ আর মাঠকে আলাদা করে চেনার উপায় নেই! পৌষমেলার মাঠেও বিকেল না গড়াতেই ক্রিকেট, ফুটবল খেলোয়ার আর ক্যারাটেদের ঠেসাঠেসি ভিড়। নবীন থেকে প্রবীণ সবার গল্প-গুজব আর আড্ডার জায়গা আজ সবুজে আচ্ছন্ন শুধুই এক ধূ-ধূ প্রান্তর! হোস্টেলের আনাচে কানাচে দেখা যেত সাইকেল নিয়ে মোবাইলবাহী যুবক-যুবতীদের। চোখ তাদের মোবাইলে আর গল্প হাসি-তামাসা চলে ইশারা-ইঙ্গিতে। তাদেরও মনে হয় শরতের মতোই গ্রীষ্ম-বর্ষার ওই রোদ্দুরটা শরীরের পক্ষে ভালো নয়! কত গল্প, কত স্বপ্ন, কত প্ল্যান, কত সুখ-দুঃখের তর্ক বিতর্ক, ঝগড়া-বিবাদ, কত আত্মহারা উচ্ছ্বাস-আনন্দ, এদের সবাইকে কবিরাজ মশাইয়ের কড়া নির্দেশ, ঘরের বাইরে যাওয়া চলবে না। তারা সবাই আজ বাড়িতে অমলের মতই সুদূরের পিয়সী হয়েও একা একা ঘরবন্দী!
![]() |
জনশূন্য শান্তিনিকেতন |
যে হাসপাতালে ডাক্তারদের চেম্বারের সামনে লম্বা লম্বা লাইন পড়ত, তা এখন প্রায় জনশূন্য! দেখে মনে হয় শান্তিনিকেতনের মানুষদের কোনও রোগই নেই, তাই রোগীও নেই, যেন কারোর কোনও অসুখই করে না! আসলে বিশ্বসংসারে আজ আমরা যে গভীর অসুখে ভুগছি আর সেটাই তো আমাদের একমাত্র রোগ! এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়াতেই তো সারা বিশ্ব মগ্ন!
সমগ্র শান্তিনিকেতনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত নজরে পড়ে স্থানে স্থানে কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মীদের। এই জনমানবহীন খাঁ খাঁ শান্তিনিকেতনকে ডাকঘরের প্রহরীর মত ঢং-ঢং-ঢং… ঘন্টা বাজিয়ে বুক দিয়ে আগলে রাখতে হবে তাঁদেরকেই। অন্যদিকে গৃহবন্দী শান্তিনিকেতনবাসী যজ্ঞপ্রিয়ার মতো, ধীর স্থির কাটাতে না চাওয়া দিনগুলি গুনে চলেছে নীরবে একা একা, আবার কবে সেই চিরচেনা শান্তিনিকেতনকে তাঁরা ফিরে পাবেন। তবুও যেমনভাবে “যেতে নাহি দিব” বললেও যেতে দিতে হয়, ঠিক তেমনই বিশ্বব্যাপী মহাসংকটের অবসানে, সকলের মঙ্গলের জন্যই, আজ এই নিস্তব্ধ নিরানন্দ শান্তিনিকেতনকেও ধৈর্য ধরে নিঃশর্তে মেনে নিতেই হয়। আশা থাক, ভরসা আসুক, সেই উৎসবমুখর ও কলতানে উচ্ছ্বল আনন্দময় শান্তিনিকেতন, বিশ্বছন্দের সুর-সঙ্গীত নিয়ে, অচিরেই তার স্বমহিমায় ফিরে আসবে!
ছবি : লেখক
Advertisement
Om Shanti
কত দিন দেখিনি তোমায়। অল্প তেই অনেক টা দেখলাম।