রূপকথার মতোই একদিন জেগে ছিল সিউর গ্রামের রাজবাড়ি

Advertisement
খ্রিস্টীয় একাদশ শতকের দিকে সিউর অঞ্চলে রাজত্ব করতেন রাজা শিবাদিত্য। তাঁর সময়কার কিছু কিছু ঘটনা আজও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে এই গ্রামে। যা অনেকটাই মনে হবে রূপকথার মতো। সব ঘটনার ব্যাখ্যা হয় না, ব্যাখ্যা দেওয়াও যায় না।
রূপকথার মতোই একদিন জেগে ছিল সিউর গ্রামের রাজবাড়ি
বিশ্বজিৎ ঘোষ : বীরভূম জেলার আমোদপুর থেকে তিন মাইল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সাঁইথিয়া থানার অন্তর্গত সিউর বা শিবপুর গ্রাম। গ্রামে যেতে হলে বোলপুর-আমোদপুর সড়ক থেকে সিউর বাস স্ট্যান্ডের পূর্ব দিকের পাকা রাস্তা ধরে কিছুটা এগোতে হবে। সরকারী নথিপত্রে গ্রামটির নাম পূর্ব সিউর নামে লিপিবদ্ধ হয়ে আছেমুসলিম শাসনকালে (খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতক) শিবাদিত্য নামে এক পরাক্রমশালী রাজা এখানে রাজত্ব করতেন। সেই রাজার নামানুসারে এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল শিবপুর, পরে অপভ্রংশ হয়ে এখন সিউর। সবুজ বনানীতে ঘেরা এই গ্রামটির একটি অংশের নাম এখনও রাজাপাড়া। রাজা শিবাদিত্যের বংশধরেরা এই পাড়ায় আজও বসবাস করছেন।
     সিউর রাজবাড়ির চত্বর এক সময়ে পরিখা দিয়ে ঘেরা ছিল। রাজবাড়ির চতুর্দিকে যে কাটা খাল ছিল, তা নৌকা যোগে পার হতে হতো। যার অংশ বিশেষ এখনও কিছুটা অবশিষ্ট আছে। স্থানীয় ভাষায় এই রকম পরিখাকে ‘গড়’ বলা হয়েছে এছাড়াও চতুর্দিকে বাঁশ এবং কাঁটা জাতীয় বেউল গাছের ঝোপ ছিল। যা ভেদ করে বহিরাক্রমণ ছিল বেশ দুঃসাধ্যের। যা বহু যুগ ধরে রাজ পরিবারকে রক্ষা করে গিয়েছে।
     তবে বিশাল রাজবাড়িটি আজ আর নেই। প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যদিও পুরনো ইটের স্তূপ আজও কিছুটা চোখে পড়ে। শোনা যায়, এক সময়ে পর পর বেশ কয়েকবার বর্গী আক্রমণ হয়েছিল এখানেআর সেই সময় থেকেই রাজবাড়িটির পতনের শুরু বলে ধারণা করা হয়। বর্গী আক্রমণ থেকে নিজেদের বাঁচাতে সমস্ত রাজ পরিবার মালদহ জেলার গৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলপরে সব কিছু স্বাভাবিক হলে তারা আবার সিউরে ফিরে আসে এবং স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তোলে
     শিবাদিত্যই ছিলেন এই বংশের প্রথম রাজা। তিনি বিয়ে করেছিলেন ‘অমরাগড়’ (বর্তমানে বর্ধমান জেলায়)-এর রাজকন্যার সাথে। তাঁর বংশধরদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অবিনাশ সিংহ, ভবানীপ্রসাদ সিংহ, রতনচন্দ্র সিংহ, অমর সিংহ, শশধর সিংহ, বিষ্ণুপ্রসাদ সিংহ, শরৎচন্দ্র সিংহ প্রমুখ।
     এই সিউর গ্রাম এবং এখানকার রাজবাড়ি নিয়ে এ এলাকায় প্রচলিত আছে নানান কাহিনী যা অনেকটাই রূপকথার মতো
     প্রচলিত কথা অনুযায়ী, সিউরের রাজবাড়ি একটা সময়ে তর্কযুদ্ধের জন্য বিখ্যাত ছিল। এই তর্কযুদ্ধের সুনামের কথা বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েশোনা যায়, সিউরের রাজসভার তর্ক পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে হারানো কোনও সহজ কাজ ছিল না। তাই অন্য অঞ্চলের তর্ক পণ্ডিতরা এদের বেশ ঈর্ষাও করত
     তখনকার সময়ে মুনিরাম তর্কালঙ্কার ছিলেন বেশনাম করা তর্ক পণ্ডিত। তিনি আবার সভাকবিও ছিলেন। তার ভিটে ছিল বোলপুরের কাছে আদিত্যপুর গ্রামে। একবার অন্য রাজসভা থেকে এক বিরাট মাপের তর্ক পণ্ডিত সিউরে এসেছিলেন মুনিরাম তর্কালঙ্কারকে তর্কযুদ্ধে হারাতে। তর্কযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে রাজা শিবাদিত্য একটি শর্ত রাখেন, বিজয়ী তার্কিক পরাজিত তার্কিকের মাথায় তার উপবিষ্ট আসনের ধুলো ঝেড়ে দেবেনসেদিন স্বাভাবিকভাবেই মুনিরাম তর্কালঙ্কার বিজয়ী হন এবং তিনি পরাজিতের মাথায় তার উপবিষ্ট আসনের ধুলো ঝেড়ে দিয়েছিলেন।
     সিউরের পাশের গ্রাম গাঙপুরে প্রবেশের মুখেই দেখতে পাওয়া যায় প্রতিষ্ঠিত ‘সিভিক্ষা মা’-কে। তার পাশেই ছিল ‘দোহা’। শোনা যায়,রাজা শিবাদিত্য এখানে রোজ স্নান করতে আসতেন। সে সময়ে দেবী রামেশ্বরী তাকে পরপর তিনদিন স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন। দেবীর নির্দেশ ছিল, তিনি এই দোহাতেই অবস্থান করছেন। ‘লাউর’ (নৌকার মাঝি)-রা তাকে শিল ভেবে মশলা বেঁটে রান্না করছে। তাতে তার শরীর নাকি জ্বলে যাচ্ছে। তাকে উদ্ধার করতে হবে। রাজা শিবাদিত্য কালবিলম্ব না করে দেবী রামেশ্বরীকে উদ্ধার করেন এবং সিউর গ্রামে নিয়ে এসে তাকে রামেশ্বর দশভুজা মূর্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরে নাকি রাজা যখনই দোহাতে স্নানে যেতেন, তার মাথার উপর কোথা থেকে একটা গামছা উড়ে আসত। তাতে তার শরীরে কোনও রোদের তাপ লাগত না।
রূপকথার মতোই একদিন জেগে ছিল সিউর গ্রামের রাজবাড়ি
রাজা শিবাদিত্যের বংশ তালিকা
     দেবী রামেশ্বরীকে ঘিরেও এ অঞ্চলে প্রচলিত আছে বিভিন্ন কথা তাকে নাকি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল কালো কষ্ঠি পাথরের মূর্তি হিসাবে। দেবী ছিল খুবই জাগ্রত। কিছু বিষয় নাকি সে একদমই পছন্দ করত না, এই যেমন – দ্বিতল বাড়ি, মহিষ পোষা, অত্যধিক শব্দ প্রভৃতি। রাজা শিবাদিত্যের পরবর্তী বংশধরেরা সে সবের তোয়াক্কা করত না। তাতে দেবী দারুণ ক্রুদ্ধ হয়েছিলতার মন্দিরের পাশেই স্থাপন করা হয়েছিল একটি চিড়ের কলতার শব্দে দেবী আরও অসন্তুষ্ট হয়। কথিত আছে, সেই শব্দ অপছন্দ করার জন্যেই সে এই গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল কিন্তু অনেকে বলেন, দেবীর মূর্তি চুরি হয়ে গিয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও তার কালো কষ্ঠি পাথরের মূর্তিটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। গ্রামে তখন নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। সারা গ্রাম জুড়ে হাহাকার পড়ে যায়। রান্না বন্ধ। চারিদিক থেকে খবর আসে মৃত্যুর। পরে কলকাতা থেকে ওই কষ্ঠি পাথরের আদলে অপর আর একটি মূর্তি আনিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়
     দেবী রামেশ্বরী ছাড়াও রাজবাড়ির পূর্ব দিকে আর একটি মন্দির প্রতিষ্ঠিত ছিল, ‘দেবী দ্বারবাসিনী’-র। তবে এটিও পরে চুরি হয়ে যায়। চুরি হওয়ার চারদিনের মাথায় তাকে আবার পাওয়া যায় আমোদপুরের অদূরে কুসুমযাত্রা গ্রামে ঢোকার মুখের এক পুকুর থেকে, জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরার সময়ে। মূর্তিটি আজও গ্রামে প্রতিষ্ঠিত আছে এবং নিত্য পুজো পাচ্ছে
     দেবী রামেশ্বরী ও দেবী দ্বারবাসিনী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখানে অন্য কোনও দেব বা দেবীর মূর্তি পুজোর চল ছিল না। শুধুমাত্র নবপত্রিকার মাধ্যমে দুর্গা পুজো হত। তবে বর্তমানে নতুন প্রজন্মের উদ্যোগে বেশ ধূমধাম করেই দুর্গা পুজো হচ্ছেনবমীর পুজোটি এখানে রামেশ্বরী নবমী”-র পুজো নামে পরিচিত। আবার রাম নবমীর সময়েও এই দেবীর পুজো হয়ে থাকে।
     সিউর বা শিবপুর গ্রামের এক মাইল উত্তরে বক্রেশ্বর নদ বয়ে চলেছে। অনেকের ধারণা, তখনকার সময়ের মানুষেরা রাজাকে ‘সেবাদিত্য’ নামে অবিহিত করতকারণ পরিবারের কারও কোনও অসুখ হলে সবাই রাজার শরণাপন্ন হত। রাজা পাষাণময়ী কালী বা নাককাটিদেবীর নির্মাল্য পুষ্পাদি দিয়ে রোগীকে সুস্থ করে তুলতেন। শিবপুর গ্রামের অদূরে সাঙ্গুল গ্রামে অশ্বত্থ গাছের নিচে এই রকম একটি দেবীর দেখা আজও পাওয়া যায় এরকমই নানান ঘটনার কথা প্রচলিত আছে এই অঞ্চলে।
     প্রাচীনত্বের নিরিখে সিউর রাজবাড়ি বীরভূমের প্রাচীন রাজবাড়িগুলির একটি বললে ভুল বলা হবে না। সময়ের শাশ্বত প্রবাহে রাজবাড়ি আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। রাজবাড়ির গর্বের সেই বৃহৎ পরিখা সেদিন তাকে বর্গী আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারলেও সময়ের অমোঘ আক্রমণ থেকে তাকে আজ আর রক্ষা করতে পারেনি। তাই রাজবাড়িটি বর্তমানে প্রায় সমাধিস্থ।
     বর্গী আক্রমণের পরেও বেশ কিছুকাল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। পরে ধীরে ধীরে মাটির বুকে আশ্রয় নিয়েছে। রাজবাড়ি চত্বরে আজও প্রমাণ স্বরূপ পড়ে আছে ভাঙা ইটের টুকরো, চুনসুরকির অবশিষ্টাংশ। তবে রাজাপাড়া নামটি এখনও বেশ প্রচলিত। এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে রাজার রাজত্ব, রাজার অস্তিত্ব। যদিও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শতাব্দী প্রাচীন এই রাজবাড়ির কথা রূপকথার মতোই মনে হতে পারে। তবে সব ঘটনার ব্যাখ্যা হয় না, অথবা ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না।
 
কৃতজ্ঞতা : তাপস সিংহ (রাজা শিবাদিত্যের বংশধর), রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (আমোদপুর জয়দুর্গা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন ইতিহাস শিক্ষক), অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য (আমোদপুর জয়দুর্গা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন বিজ্ঞান শিক্ষক)
Advertisement
Previous articleপাহাড়পুরের প্রাচীন দশোহরা উৎসব পুরোটাই ফিকে এবছর
Next articleসন্ধান পাওয়া গেল সবচেয়ে প্রাচীন স্থলচর প্রাণীটির

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here