Advertisement
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ বাংলা সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টি। উপন্যাসটির অপু-দুর্গা যেন গ্রাম-বাংলারই চির পরিচিত দুটি ছেলে-মেয়ে। বাল্যকালে মানস পটে সেই অপু-দুর্গা সাজেনি এমন মানুষ বোধহয় এই বাংলায় খুব কমই পাওয়া যাবে। উপন্যাসটি নিয়ে একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছিলেন অস্কার জয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায়। তবে তাঁর বহু পূর্বে এই উপন্যাসটি সামনে এনেছিলেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায়। – ছবি : সংগৃহীত
|
বিজয় ঘোষাল : ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপ পায়। তার অনেক আগে অবশ্য বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসের সঙ্গে তার অমর চরিত্র অপু-দূর্গা, সর্বজয়া, হরিহর-কে বাঙালি পাঠকের দরবারে নিয়ে এসেছিলেন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি সেকালে পাঠক মহলে উপেনবাবু নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। এই উপেনবাবুর আর একটি পরিচয় ছিল, তিনি ছিলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মামা।
যাইহোক, সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় ও তাঁর সাড়া জাগানো ‘পথের পাঁচালী’ উভয়ই আত্মপ্রকাশ ঘটে উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ‘বিচিত্রা’ সম্পদনার মধ্য দিয়ে। উপন্যাসটির প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯২৯ সালে (সূত্র : উইকিপিডিয়া)। এবার নজর দেওয়া যাক, কেমনভাবে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’-র প্রকাশ ঘটল, সেই দিকে।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়-এর জন্ম ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চব্বিশ পরগনার বনগ্রামে এক অতি দরিদ্র পরিবারে। শৈশব থেকেই লেখালিখির প্রতি আকৃষ্ট হন তিনি। কর্মজীবনে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করলেও, পরে তিনি বিহারের ভাগলপুরে জমিদারের সেরাস্তাখানায় খাতা লেখার কাজ শুরু করেন। এই ভাগলপুরে ছিলেন উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তখন উপেনবাবু ভাগলপুরে থাকা বেশ কিছু আড্ডাপ্রিয় সাহিত্য রসিক বাঙালিদের নিয়ে তাঁর বৈঠকখানায় সাহিত্য সভার আসর বসাতেন। চিরকাল সাহিত্যপ্রেমী বিভূতিভূষণের এই খবরটা কর্ণগোচর হতে বেশি সময় নেয়নি। প্রতিদিন সেরেস্তার খাতার কাজ সেরে সন্ধ্যায় সাহিত্য আড্ডায় চলে যেতেন। কিন্তু বিভূতিভূষণের বসার স্থান ছিল একবারে কোণে। আসতেন আবার চুপচাপ চলেও যেতেন। কিন্তু কোনওদিন ওই সাহিত্য সভার আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন না।
ব্যাপারটি নজরে পড়ে সভার প্রধান উদ্যোগী উপেনবাবুর। তাই বিভূতিভূষণকে একবার সভার শেষে ডেকে জানতে চাইলেন, রোজ তিনি আড্ডায় আসেন, আবার চলেও যান। কিন্তু কবিতা-গল্প কিছুই পাঠ করেন না কেন। তিনি কি কিছুই লেখেন না। এর পরই অনুরোধ করলেন কবিতা পাঠ করার। বিভূতিভূষণ উত্তরে বলেছিলেন, তিনি কবিতা বা গল্প কিছুই লেখেন না। তবে একটি উপন্যাস লিখেছেন।
তাঁর কথায় উপেনবাবু বেশ অবাকই হন। জানতে চাইলেন, কত পাতার। বিভূতিভূষণ জানালেন, চারশো পাতার। সে সময় উপেনবাবুর ধারণা হয়েছিল, হয়তো কল্পনা করে উপন্যাসের চারশো পাতা ভরিয়ে গিয়েছেন তিনি। তবুও ইচ্ছা হল, নবীন এই সাহ্যিত্যপ্রেমীর উপন্যাসটি একবার পড়ে দেখার। পরের দিন তিনি বিভূতিভূষণকে আনতে বললেন তাঁর চারশো পাতার উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। বিভূতিভূষণ পরের দিন আড্ডার শেষে উপেনবাবুকে তাঁর পাণ্ডুলিপিটি পড়তে দিলেন। বলা বাহুল্য এই পাণ্ডুলিপিটি ছিল ‘পথের পাঁচালী’-র।
বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেল। বিভূতিভূষণ অপেক্ষা করছেন কখন উপেনবাবু তাকে কিছু জানাবেন। এদিকে উপন্যাসের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেও সংঙ্কোচ বোধ করছেন তিনি। একদিন সাহিত্য সভার শেষে বিভূতিভূষণকে ডেকে উপেনবাবু নিজেই জানতে চাইলেন, এই লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ হয়েছে কিনা। বিভূতিভূষণ জানালেন, একবার ‘প্রবাসী’-তে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু মনোনীত হয়নি। উপেনবাবু নিশ্চিত করে বললেন, এই উপন্যাস প্রকাশের দায়িত্ব তিনি নিচ্ছেন।
এর অল্পদিনের মধ্যেই উপেনবাবু ফিরে আসেন কলকাতায়। তিনি ধরেই নিয়েছেন, তাঁর সম্পাদনায় ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশ হবে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায়। পরে বিভূতিভূষণ কলকাতায় ফিয়ে এসে উপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন ‘বিচিত্রা’ অফিসে। উপেনবাবু দেরি না করে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি নিয়ে ‘বিচিত্রা’-তে ধারাবাহিকভাবে ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশ করতে শুরু করলেন।
তারপর পুরোটাই ইতিহাস। বাঙালি পাঠক মহলে অমর হয়ে গেল ‘পথের পাঁচালী’। আর তারই সঙ্গে উপন্যাসের প্রতিটা চরিত্র। অপু-দুর্গা হয়ে গেল যেন কাছের মানুষ। বাল্যকালের মানস পটে অপু-দুর্গা সাজেনি এমন মানুষ এই বাংলাই খুব কমই পাওয়া যাবে।
ধারাবাহিক উপন্যাস পড়ে পাঠক মহলে ইতিমধ্যেই বেশ পরিচিত হয়ে গিয়েছেন বিভূতিভূষণ। ‘শনিবারের চিঠি’-র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস সিদ্ধান্ত নিলেন ‘পথের পাঁচালী’ এবার বই আকারে প্রকাশ করবেন। এর জন্যে আগাম ৯০ টাকাও বিভূতিভূষণকে দিলেন তিনি। শেষে ১৯২৯ সালে প্রথম বই আকারে প্রকাশ পেল ‘পথের পাঁচালী’।
তথ্যঋণ :
১. ‘বিভূতিভূষণ ও পথের পাঁচালীর আত্মপ্রকাশ’, দোলগোবিন্দ মুখোপাধ্যায়
২. ‘উপেনবাবুর উপন্যাস আবিষ্কার’, অন্য কথায় পিনাক বিশ্বাস, দৈনিক Tech Touch টক
৩. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, পথের পাঁচালী গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশ, এস. বি. এস. পাবলিকেশন
Advertisement