Advertisement
সুজয় ঘোষাল : বর্তমান সভ্যতায় আলু বাঙালির রান্নাঘরে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। যদিও আলু ভারতীয় উপমহাদেশের কোনও নিজস্ব ফসল নয়, কয়েক’শ বছর আগে পর্তুগাল থেকে এই অঞ্চলে আমদানি করা হয়েছিল। গোলাকৃতির কন্দ জাতীয় এই সবজিটিকে এখন বারোমাসই হাটে-বাজারে পাওয়া যায়। গৃহকর্তা বাজারের থলি ঝুলিয়ে বাজার করতে বেরুলে সর্বপ্রথম খোঁজ করেন এই আলুকেই। যাইহোক, রোজকার খাদ্যতালিকায় কোনও না কোনও আলুর পদ অবশ্যই থাকে। সে আলুপোস্ত হোক বা আলুভাজা, অথবা মাছের ঝোল।
পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত অঞ্চলে শীতের মরশুমে আলু চাষ হতে দেখা যায়। তার মধ্যে বিশেষ কতকগুলি অঞ্চল আলু চাষের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে। বীরভূম জেলার মূয়রাক্ষী নদী সংলগ্ন মূয়রেশ্বর ২নং ব্লকের রামনগর, মালঞ্চা, নপাড়া, আমড়া, উলকুন্ডা, রামবাটি, ষাটপলসা প্রভৃতি হল সেই অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও ময়ূরাক্ষী নদী পেরিয়েমুশির্দাবাদ জেলার পানুটিয়া, তালবোনা, পেটারী ইত্যাদি অঞ্চলেও ব্যাপক আলুর ফলন হতে দেখা যায়।
তাই এক কথায় বলতে হয়, মূয়রাক্ষী নদী তীরবর্তী অঞ্চলের কৃষকরা আলুকে একটি গুরত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল হিসাবেই দেখে আসছেন। প্রতি বছর আলু ফলিয়ে অনেক কৃষক সমাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হচ্ছেন। এই গ্রামগুলিতে দেখা যায় আমন ধান চাষের পর পরই আশ্বিন মাসের শেষের দিকে আলু ফলাতে তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। দোয়াস মাটির পাশাপাশি বেলে মাটিতেও আলুর ফলন ভালো হয়। মূয়রাক্ষী নদী তীরবর্তী এই গ্রামগুলিতে বেলে ও দোঁয়াশ মাটির প্রাচুর্য বেশি। তাই এখানে আলু চাষও হয় অন্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি। এই অঞ্চলের শুধুমাত্র রামনগর গ্রামেই চলতি বছর চাষিরা আলু ফলিয়েছেন প্রায় ৫০-৬০ হেক্টর জমিতে।
আলু চাষের জমিতে বিভিন্ন ধরনের সাথী ফসলও ফলিয়ে থাকেন চাষিরা। এই সব ফসলের মধ্যে বাঁধাকপি, ফুলকপি, মুলো, বিট, গাজর, কুমড়ো ইত্যাদির নাম করতে হয়। এই সাথি ফসল থেকেও প্রতি বছর বেশ অর্থ উপার্জন করেন তাঁরা।
তবে সব বছর আলুর ফলন ভালো হলেই যে ভালো অর্থ উপার্জন হয়, তা কিন্তু নয়। রামনগরের নিকটবর্তী মালঞ্চা গ্রামের ৭৫ বছর বয়সী বিশ্বনাথ ভল্লা গত তিন দশক ধরে নিজের ১৫ কাটা জমিতে আলু চাষ করে আসছেন। এই প্রবীণ চাষি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন, আলু চাষ করা অনেকটা লটারী কাটার মতো। অর্থাৎ অনেকটাই ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে আলু চাষ করতে হয়। বাজারদর ভালো পেলে চাষি বড়লোক হবে, আর বাজারদর কম পেলে চাষি আগের অবস্থায় থাকবে। তাই চাষির লটারীর নাম্বার মিলবে কিনা তা নির্ভর করবে বাজারদর। এই গ্রামের আর চাষি বিপদতারণ ভল্লা জানালেন, গত বছর আলুর দাম ঠিকঠাক না পাওয়ার জন্য অনেক চাষিই ক্ষতির মুখ দেখেছিলেন। তবে এবছর যাঁরা আগাম আলু তুলেছেন তাঁরা ১০০০ টাকা বস্তা পিছু পাচ্ছেন।
এইভাবেই মূয়রাক্ষী নদী তীরবর্তী অঞ্চলের কৃষকরা আলু চাষ করে চলেছেন। লাভের পিছনে সুপ্ত অবস্থায় অবশ্যই আছে চাষির অফুরন্ত পরিশ্রম। এমন অনেক চাষি আছে যাঁদের কৃষাণ কেডিট কার্ড নেই। তারা ব্যাঙ্ক থেকে নিজের জমানো টাকা তুলে বা সঞ্চিত ধান বিক্রয় করে আলু ফলানোর মূলধন জোগাড় করেন। কিন্তু আলু চাষ করতে তাঁরা কোনও বছরই নারাজ নন।
Advertisement