Advertisement
রেমা মণ্ডল : সিউড়ি–বোলপুর রোডের সেকমপুর বাস স্টপ থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটারের পথ পার্বতীপুর। আর পাঁচটা সাধারণ গ্রামের মতোই এই গ্রামটিও সবুজ বনানীতে ঢাকা। যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন ভালো নয়। গ্রামটিতে যাওয়া–আসার ভরসা শুধুমাত্র সাইকেল, মোটর বাইক বা টোটো।
গ্রামের এক প্রান্ত দিয়ে বয়ে গিয়েছে বক্রেশ্বর ও চন্দ্রভাগা নদী। আসলে এই নদী দুটির সংযোগস্থলেই পার্বতীপুর গ্রামটির অবস্থান। তবে ঐতিহাসিক দিক থেকে বীরভূমের এই গ্রামটির গুরুত্ব কিছু কম নয়। এখানেই এককালে জমিদারি করতেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়।
ভিডিও দেখতে ওপরে ক্লিক করুন 👆
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের এই জমিদারি ছিল সতেরশো সালের শেষের দিকে। কথিত আছে, মাত্র দুই পয়সা নিয়ে জমিদারি শুরু করেছিলেন তিনি। তবে আর পাঁচটা সাধারণ জমিদারের মতো ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রজাদরদী। প্রজার সুখই ছিল তাঁর সুখ। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারকে তোষামোদ করে জমিদারি না বাড়িয়ে প্রজা কল্যাণেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। যদিও সেসব ইতিহাস কোথাও লেখা নেই। গ্রাম্য জীবনের আনাচে–কানাচে ছড়িয়ে আছে সেই সব কাহিনী।
পার্বতীপুর গ্রামটি বেশ সাজানো গোছানো। গ্রামে প্রবেশের পরই দেখা মিলবে সারিবদ্ধ পাঁচটি বড়ো শিব মন্দিরের। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, একই মন্দিরের পাঁচটি মাথা। বাম ও ডানদিকের মন্দির দুটি যথাক্রমে ত্রৈলোক্যনাথ ও তাঁর ছোটো ভাই চন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতি উদ্দেশ্যে নির্মিত। আর মাঝের মন্দির তিনটি নির্মিত হয়েছে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার আদলে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের দুই পুত্র বিষ্ণু মুখোপাধ্যায় ও গিরিশ মুখোপাধ্যায় এবং এক মেয়ে কল্যাণেশ্বরীর স্মৃতি উদ্দেশ্যে।
গ্রামে একটি সুপ্রাচীন কালীমন্দির এবং দুর্গামন্দিরও আছে। সিংহ চিহ্নিত দুর্গামন্দিরটিতে আজও নিত্য পুজোর চল রয়েছে। বর্তমানে এই মন্দিরের দায়িত্বে আছেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ভাগ্নের উত্তরসূরিরা।
![]() |
গোপাল মন্দির |
তবে পার্বতীপুরের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দিরটি হল গোপালমন্দির। মন্দিরটি কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা আর জানা যায় না। তবে গ্রামবাসীদের কথায়, এককালে এখানে অষ্টধাতুর মূর্তি ছিল। মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের পিতা নীলমাধব ঋষি। যদিও সেই মূর্তিটি আজ আর নেই। চুরি হয়ে গিয়েছে।
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের নিজের তৈরি প্রাসাদটি এখন নেই। সময়ের স্রোতে তলিয়ে গিয়েছে মাটির নিচে। তবে তাঁর উত্তরসূরিদের নির্মিত বিশাল প্রাসাদটির অবশিষ্টাংশ আজও রয়েছে। সাধারণ ছোটো ছোটো ইটের পাশাপাশি গোলাকৃতির ইট দিয়ে সাজানো এই প্রাসাদটির দেওয়াল থেকে প্লাস্টার ছাড়িয়ে গিয়েছে অনেককাল আগেই। এখন চুন–সুরকির টালির ছাদটিও ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। প্রাসাদের চারিদিকে বন–জঙ্গলেও ছেয়ে গিয়েছে এখন।
![]() |
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের নিজের প্রাসাদের অবশিষ্টাংশ |
গ্রামের এক প্রান্তে আজও দাঁড়িয়ে আছে কাছারি বাড়ি। এককালে জমিদারির হিসাব–নিকাস, খাজনা আদায় সহ অন্য সমস্ত কিছুই এখানে হত। ব্যবহারের উপযোগী করতে বহুবার সংস্কারও করা হয়েছে এটি। কিন্তু এখন আর ব্যবহারের উপযুক্ত নয়।
আরও একটি প্রাসাদের দেখা মিলবে এই গ্রামে। প্রাসাদটি ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ছোটো ভাই চন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের। সুবিশাল এই প্রাসাদটিরও এখন ভগ্নদশা। জায়গায় জায়গায় খসে পড়েছে প্লাস্টার, ফেটে গিয়েছে দেওয়াল। তবে দোতলায় ওঠার সিঁড়িটি আজও অক্ষত রয়েছে। সরু সিঁড়ি পথ ধরে ওপরে উঠলেই নজরে পড়বে উন্মুক্ত ছাদ। তবে ছাদ বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ভেঙে পড়েছে সবটাই।
এই প্রাসাদের নিচেই এককালে ছিল গোপন সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গ পথটি আজও আছে। তবে কি কারণে এই সুড়ঙ্গ নির্মিত হয়েছিল তা আর জানা যায় না। সুড়ঙ্গ মুখটি বেশ সরু। ভেতরটা একদমই অন্ধকার।
![]() |
গোপন সুরঙ্গের প্রবেশ মুখ |
জমিদার ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা কল্যাণেশ্বরী দেবীর উত্তরসূরিদের একজন তরুণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের বর্তমান উত্তরসূরিদের কেউই এখন আর এই গ্রামে থাকেন না। কর্মসূত্রে তাঁরা প্রত্যেকেই অন্যত্র চলে গিয়েছেন।
যাইহোক, ইতিহাস আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, না আমরা ইতিহাস থেকে দূরে সরে যাচ্ছি? – এরকম প্রশ্ন চলতেই থাকবে অনন্তকাল ধরে। পার্বতীপুরের এই জমিদারির ইতিহাস কোথাও লেখা নেই। কেউ লিখেও রাখেনি। শুধু লোকমুখেই টিকে রয়েছে এখনও।
- All rights reserved
Advertisement
জনদর্পনের এই প্রয়াস জারি থাকুক। পার্বতীপুরের অজানা অধ্যায়কে এমনভাবে তুলে আনার জন্য জনদর্পনকে ধন্যবাদ। সমৃদ্ধ হলাম।
Janadarpan er ei bisoi ti bes akorshoniyo..
বেশ সুন্দর লেখা। এমন তথ্য এবং গল্প আমাদের সমৃদ্ধ করবে।
বেশ সুন্দর লেখা। এমন তথ্য এবং গল্প আমাদের সমৃদ্ধ করবে।