Advertisement
মানুষ বাদে মাকড়সা-ই একমাত্র প্রাণী, যারা শিকার করতে জাল ব্যবহার করে। এদের জালেরও আবার রকমফের রয়েছে। শিকার করতে বিভিন্ন রকমের মাকড়সা আলাদা আলাদা ধরণের জাল ব্যবহার করে। মাকড়সার জাল আসলে প্রোটিন জাতীয় রেশম। প্রায় ৪ কোটি বছর আগে এই পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটেছিল মাকড়সাদের। – ছবি : সংগৃহীত
|
সজয় পাল : পৃথিবীতে যত রকম বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ রয়েছে তাদের অধিকাংশই প্রায় মাংসাশী। এই মাংসাশীরা জীবন ধারণের জন্য অন্য ছোটো পতঙ্গদের বিভিন্ন উপায়ে শিকার করে থাকে। এদের মধ্যেই রয়েছে অনেক বড় বড় শিকারি। যাদের শিকার ধরার কৌশল দেখলে বিস্ময়ের শেষ থাকে না। এ ব্যাপারে মাকড়সাকে অবশ্যই প্রথম সারিতে রাখতে হয়। কারণ তাদের শিকার ধরার কৌশল অন্যদের থেকে একদমই আলাদা। ধারণা করা হয়, মানুষ বাদে মাকড়সা-ই একমাত্র প্রাণী, যারা শিকারের জন্য জাল বা ফাঁদ ব্যবহার করে।
মাকড়সার এই জাল নিয়েও কিন্তু রহস্যের শেষ নেই। ভাবলে অবাক হতে হয়, ছোট্ট মাকড়সা কিভাবে অত বড় একটা জাল বা ফাঁদ তৈরি করে! মাকড়সার জাল আসলে এক ধরণের প্রোটিন দিয়ে তৈরি রেশম। যা তাদের শরীরের রেশম গ্রন্থিতে উৎপন্ন হয়। এই গ্রন্থিটি আবার জাল তৈরির এক অদ্ভুত যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকে। প্রকৃতপক্ষে এই রেশম আঠাল তরল পদার্থের হয়। কিন্তু শরীরের বাইরে বেরিয়ে এলে, তা বাতাসের সংস্পর্শে কঠিন ফাইবারে রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। মজার ব্যাপার, মাকড়সা মাঝে মধ্যেই শিকারের অভাবে তার তৈরি পুরনো জালকেই খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে থাকে।
প্রোটিন দিয়ে তৈরি মাকড়সার এই রেশমের ফাইবার কিন্তু মোটেও হেলাফেলা করার মতো নয়। তা যথেষ্ট সূক্ষ্ম এবং অত্যন্ত শক্ত। ‘ডারউইন বার্ক’ নামে এক প্রকার মাকড়সার রেশম পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাকৃতিক ফাইবার। যার সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র ‘কেভলার’-এর। এই কেভলার সাধারণত বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। শক্তিশালী রেশমের সাহায্যে ‘ডারউইন বার্ক’ মাকড়সারা কোনও নদী বা দীঘির উপর অন্য পতঙ্গ শিকার করতে জাল তৈরি করে। সেই জালে প্রায়ই ছোটো থেকে মাঝারি আকারের উড়ন্ত পাখিদেরও আটকে পড়তে দেখা যায়।
একটা বড়সড় জাল তৈরি করতে মাকড়সার যথেষ্ট দৈহিক পরিশ্রম করতে হয়। আবার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনারও প্রয়োজন হয় এক্ষেত্রে। কোথায়, কতটা বড় বা কিরকম ধরণের জাল তৈরি করলে পরিমিত শিকার করা যাবে তা তাদের জন্ম থেকেই রপ্ত করতে হয়। এ ব্যাপারে কেউ তাদের শিখিয়ে বা দেখিয়ে পর্যন্ত দেয় না। মাকড়সার জালের আবার রকমফেরও রয়েছে। শিকার করতে বিভিন্ন প্রজাতির মাকড়সা আলাদা আলাদা প্রকৃতির জাল ব্যবহার করে।
(১) বৃত্তাকার জালক – দেখতে ঠিক যেন স্পোকসহ সাইকেলের চাকার মত। খুব শক্ত রেশম দিয়ে তৈরি এই মরণ ফাঁদ মাকড়সা উড়ন্ত পতঙ্গ ধরতে ব্যবহার করে।
(২) জট পাকানো জালক – দেখলে মনে হবে যেন বিনা পরিকল্পনায় ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। রেশমের সুতোগুলো অত্যন্ত আঁকাবাঁকাভাবে নিয়ে গিয়ে এই ধরণের ফাঁদ তৈরি করে মাকড়সা। এই জালকগুলো শক্ত সামর্থ্য পতঙ্গ শিকার করতে ব্যবহার করা হয়।
(৩) পশমাবৃত জালক – এর সুনির্দিষ্ট কোনও রূপ থাকে না। দেখতে অনেকটা ছোটো ছোটো পশমের থলের মতো। খুব ছোটো পতঙ্গ ধরতে এক ধরণের মাকড়সা পরিবার এই রকম ফাঁদ তৈরি করে।
(৪) চোঙাকৃতি জালক – দেখতে সবচেয়ে সুন্দর এই ফাঁদটির মাঝে একটি বড়সড় ফানেলের মত অংশ থাকে। খুব সূক্ষ্ম রেশম দিয়ে তৈরি করার জন্য অত্যন্ত মোলায়েম বলে মনে হয়। ফানেলের অংশ ছাড়া এই প্রকার ফাঁদে বিশেষ কোথাও ফাঁক থাকে না বললেই চলে। ফানেলের ভেতর দিয়ে আসার পথে ছোটো ছোটো পতঙ্গ ফাঁদের দুপাশে আটকে যায়।
(৫) শয্যাচ্ছাদন জালক – ঘাস বা পাতার ফাঁকে ফাঁকে এই রকম ফাঁদ তৈরি হয়। এই ফাঁদগুলি বেশি বড় হয় না। দেখতে অনেকটা ছোটোদের দোলনার মতো।
ভূমিভাগ ছাড়াও জলের নিচে কিছু মাকড়সা বসবাস করে। ‘ডিভাইন বেল’ নামের মাকড়সা সাধারণত জলেরই জীব। তারা জলের নিচে অন্য মাকড়সাদের মত ফাঁদ বা জাল তৈরি করে শিকার ধরে।
যে কোনও ফাঁদ তৈরি করতেও মাকড়সাদের বিশেষ ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’ পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়, যা তারা জন্ম থেকেই রপ্ত করতে পারে। ফাঁদ তৈরির ব্যাপারে “বৃত্তাকার জালক”-এর প্রসঙ্গই উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক। “বৃত্তাকার জালক”-এর ক্ষেত্রে একটা মাকড়সা প্রথমে এক কোণ থেকে অপর কোণে বার কয়েক পায়চারী করে জায়গা সম্বন্ধে কিছুটা ধারনা করে নেয়। তারপর বাতাসের ওপর ভর করে যে কোনও এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে রেশম বিছিয়ে ইংরেজি বর্ণমালার ‘ভি’ আকৃতি দান করে। এবার ‘ভি’-এর নিচের অংশ থেকে রেশম টেনে তাকে আবার ‘ওয়াই’ আকৃতির রূপ দেয়। ঠিক এই রকমভাবে বিভিন্ন কোণ থেকে বারবার ‘ভি’ এবং ‘ওয়াই’ করতে করতে অবশেষে একটা “বৃত্তাকার জালক”-এর সৃষ্টি করে। সবশেষে মাকড়সাটি জালকের মাঝে বসে শিকারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
ফসিলস বিশ্লেষণ করে কীট বিজ্ঞানীদের অনুমান এই পৃথিবীতে মাকড়সাদের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৪ কোটি বছর আগে। তখন অবশ্য তাদের শারীরিক আকার ছিল এক একটা বিশাল দৈত্যাকার। পরিবেশে টিকে থাকতে পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেকে বহুবার পাল্টে ফেলেছে তারা। জীব বৈচিত্র্যের প্রাধান্য অনুসারে বিজ্ঞানীরা মাকড়সাকে সপ্তম স্থানে রেখেছেন।
সূত্র :
১. এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা (ওয়েব পেজ)
২. রিডার্স ডাইগেস্ট (ওয়েব পেজ)
৩. ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়াম
Advertisement