আদিবাসী লোককথা অনুযায়ী, আর্যরা ভারতে প্রবেশের পরই স্থানীয় বাসিন্দা বা আদিবাসীদের কোণঠাসা করতে শুরু করেছিল। তাদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের বনজঙ্গল দখল করে বসতি গড়তে শুরু করেছিল। আর এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল মহিষাসুর বা হুদুড় দুর্গা। এমনিতেই গৌরবর্ণ আর্যদের তুলনায় কৃষ্ণবর্ণ আদিবাসীদের শারীরিক ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু আর্যদের মস্তিষ্ক প্রসূত বুদ্ধি ছিল অনেক তীক্ষ্ণ। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

সজয় পাল : বড্ড ব্যতিক্রমী ঢঙ্গে আয়োজিত হলেও অবশেষে সম্পন্ন হল দুর্গোৎসব। যদিও মন্দিরের অন্দরে প্রবেশের কোনও অনুমতি ছিল না এবছর। ছোট মণ্ডপের ক্ষেত্রে ৫ মিটার আর বড় মণ্ডপের ক্ষেত্রে ১০ মিটার দূর থেকেই এবছর প্রতিমা দর্শন করে ফিরতে হয়েছে। কারণ সেই করোনা! এই ‘করোনা’ নামের ‘ভিলেন’-টা বড্ড জালিয়েছে এবার। মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ভালো করে ‘মা’-য়ের মুখটাও দর্শন করতে দিল না কাউকে। অন্যান্য বছরের মতো মণ্ডপ প্রাঙ্গণে আয়োজন করতেও দিল না কোনওরকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
যাইহোক, দুর্গোৎসব আপাতত এবছরের মতো শেষ। সকলের একান্ত প্রার্থনায় আগামী বছর করোনা মুক্ত পরিবেশেই অনুষ্ঠিত হবে সামনের দুর্গোৎসব। এই আশা এখন ছেলে-বুড়ো প্রায় সকলেরই। কারণ বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গোৎসবে মন খুলে সামিল না হতে পারলে, যেন গোটা বছরটাই বৃথা মনে হয়। এই উৎসবের আলাদা মাধুর্য রয়েছে যে। আনন্দের ঢেউ ভাঙে এখানে।
তবে সকলেরই যে আনন্দের ঢেউ ভাঙবে, এমন কোনও কথা নেই। আদিবাসী সমাজে কিন্তু এই দুর্গোৎসব আসে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায়। সেখানে অসুর অর্থাৎ মহিষাসুরকে কখনওই হিন্দু সম্প্রদায়ের মতো ‘ভিলেন’ বলে মনে করা হয় না। বরং বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এই মহিষাসুরকে তারা তাদের পরম পূজনীয় রাজা হিসাবে মনে করে।
আসলে হিন্দু সম্প্রদায় যা কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করে তা তাদের হিন্দু পুরাণ মতে, যা প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বের আর্যদের রীতিনীতিকে অনুসরণ করে সৃষ্টি। আর্য বা হিন্দু শাস্ত্রানুযায়ী দুর্গাকে দেবী বা ঈশ্বর আর মহিষাসুরকে অসুর বা ‘ভিলেন’ রূপে দেখানো হয়েছে। সেখানে প্রবল পরাক্রমশালী এক বীভৎস অত্যাচারী অসুরকে যখন স্বর্গের কোনও দেবতা পরাস্ত বা বধ করতে পারেনি, তখন একজন দেবীকে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে পরাস্ত করতে। এবং অবশেষে সেই দেবী অর্থাৎ দেবী দুর্গা বধ করতে সক্ষম হয় মহিষাসুরকে।
কিন্তু আদিবাসী লোককথায় এই ঘটনাটিকেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। সেখানে মহিষাসুরকে নায়ক রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। আদিবাসী লোককথায় মহিষাসুর অর্থাৎ ‘হুদুড় দুর্গা’ ছিল একজন প্রজাবৎসল সম্রাট। এখানে হুদুড় কথার অর্থ বিদ্যুৎ বা বজ্র, আর দুর্গা তাদের কাছে একটি পুংলিঙ্গ শব্দ মাত্র, যার অর্থ দুর্গের রক্ষক অর্থাৎ রাজা বা সম্রাট। হুদুড় দুর্গার সম্পূর্ণ মানে করলে দাঁড়াবে প্রবল ক্ষমতাশালী একজন দুর্গ রক্ষক। যাকে আদিবাসী সম্প্রদায় নিজেদের রাজা হিসাবে মনে করে।
আসলে আদিবাসী লোককথা অনুযায়ী, আর্যরা ভারতে প্রবেশের পরই স্থানীয় বাসিন্দা বা আদিবাসীদের কোণঠাসা করতে শুরু করেছিল। তাদের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের বনজঙ্গল দখল করে বসতি গড়তে শুরু করেছিল। আর এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল মহিষাসুর বা হুদুড় দুর্গা। এমনিতেই গৌরবর্ণ আর্যদের তুলনায় কৃষ্ণবর্ণ আদিবাসীদের শারীরিক ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি (হিন্দু পুরাণে একাধিকবার দেবতাদের তুলনায় অসুরদের শারীরিক ক্ষমতার কথা উল্লেখ রয়েছে)। কিন্তু আর্যদের মস্তিষ্ক প্রসূত বুদ্ধি ছিল অনেক তীক্ষ্ণ। তারা লক্ষ্য করেছিল আদিবাসী সমাজে স্ত্রীদের মর্যাদা ছিল উঁচুতে। তখন হুদুড় দুর্গাকে বধ করতে এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল দুর্গা নামের এক নারীকে। আর সে-ই ছল করে হুদুড় দুর্গাকে বধ করেছিল।
যদিও পৌরাণিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সমস্ত ঘটনাগুলিকে মেনে নেওয়া হলেও ঐতিহাসিক দিক থেকে এর কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তবুও আশ্চর্য রকমভাবে এই বঙ্গের কোচবিহার বা পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডের বিশেষ কিছু অঞ্চলে আজও ‘অসুর’ নামে এক শ্রেণীর আদিবাসী সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব রয়েছে। দুর্গা দ্বারা মহিষাসুর বা হুদুড় দুর্গা বধ হওয়া তারা আজও মেনে নিতে পারেনি। তাই দুর্গোৎসবের দিনগুলি নিজেদের ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখে শোক পালন করে তারা, যাতে কোনওভাবেই উৎসবের ধ্বনি তাদের কানে না পৌঁছায়। অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় আজও ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত তাদের শোক উৎসব হিসাবে ‘দাঁশাই নাচ’-এর আয়োজন করে।
তবে সময়ের সাথে সাথে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। আদিবাসীরাও এখন সামিল হয় দুর্গোৎসবে। হিন্দু শাস্ত্রেও এখন আর অনার্য বা অসুরদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়নি। এই উৎসবে সামিল হওয়ার পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়েছে তাদের। আর তাই দুর্গার পাশাপাশি মহিষাসুরকেও রীতিমতো শাস্ত্র মেনে পুজো করা হয়।