দেবী দুর্গা দশ হাতে অস্ত্র ধারণ করে অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করেছে। এখানে দেবীকে দশভুজাও বলা হয়ে থাকে। তবে বাস্তবেও এমন দশভুজার দর্শন পাওয়া যায় কখনও কখনও। বীরভূম জেলার খোদ আমোদপুরে এরকমই এক দশভুজার সন্ধান পাওয়া গেল সম্প্রতি। তিনি মহিলা টোটো চালক উত্তরা মহুলি। এই বছরের ভাদ্র মাসে স্বামী জন্ডিসে মারা যাওয়ার পরই টোটো চালানোকেই নিজের পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন তিনি। বাড়ির নিত্যদিনের কাজ সেরে সকাল ৭টাতেই টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পথে। – ছবি : জনদর্পণ প্রতিনিধি |

সুজয় ঘোষাল ও বিজয় ঘোষাল : কিছুদিন পরই বাঙালিরা মাততে চলেছে তাদের শ্রেষ্ঠ উৎসব দেবী দুর্গার আরাধনায়। দেবী এখানে দশভুজা। দশ হাতে অস্ত্র ধারণ করে অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করে দেবী হয়েছে দুর্গতিনাশিনী। তবে বাস্তবেও এমন দশভুজার দর্শন পাওয়া যায় কখনও কখনও। বীরভূম জেলার খোদ আমোদপুরে এরকমই এক দশভুজার সন্ধান পাওয়া গেল সম্প্রতি। তিনি আমোদপুর পঞ্চায়েতের ভগবতীপুর গ্রামের মহিলা টোটো চালক উত্তরা মহুলি।
কেনও তিনি দশভূজা? উত্তর মিলবে তাঁর কাজে। উত্তরা দেবীর স্বামী খোকন মহুলি মারা গিয়েছেন এই বছরের ভাদ্র মাসে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে। স্বামী পেশায় ছিলেন একজন টোটো চালক। স্বামী মারা যাওয়ার পরই অভাবের সংসারে আরও গাঢ় হয়ে নেমে আসে দুর্দশা। দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার চালানো যেন কঠিন হয়ে উঠল। তবু হাল ছাড়েননি তিনি। উত্তরা দেবী অন্য কোনও উপায় না দেখে আঁকড়ে ধরলেন স্বামীর রেখে যাওয়া টোটো-টিকে। টোটো চালানোকেই বেছে নিলেন জীবনের পেশা হিসাবে। ছেলেদের খাওয়ানো, পড়ানো ও মানুষের মতো মানুষ করার চিন্তায় উত্তরা দেবী এখন রোজ টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পথে।
উত্তরা দেবী জানালেন, আগে তিনি টোটো চালাতে জানতেন না। দুপুরে স্বামী যখন বাড়ি ফিরতেন, নিছকই শখের বসে শিখে নিয়েছিলেন টোটো চালানো। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পর যেন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। সংসারের হাল ধরতেই শখের সেই টোটো চালানোকেই এবার পেশাদারীতে পরিণত করে ফেললেন তিনি।
তিনি আরও জানালেন, স্বামীর অবর্তমানে তাঁর দুই ছেলেকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বড় ছেলে অসীম মহুলী পাশ্ববর্তী রাজারামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র। আর ছোট ছেলে অনিমেষ মহুলি পড়ছে পাশের গ্রাম কুচুইঘাটা বিদ্যালয়ে।
রোজ আধার থাকতেই ঘুম থেকে উঠতে হয় তাঁকে। তারপর রান্না সহ ঘরের অন্যসব কাজ সেরে সকাল ৭টায় টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পথে। আবার দুপুর নাগাদ ফিরতে হয় তাঁকে বাড়িতে। দুপুরের খাবার খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়েন বিকাল ৩টেয়। এরপর বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। তবে ভালো আয়ের সুযোগ এলে অন্যের চাষের ক্ষেতে ‘মুনিষ’-এর কাজও করেন তিনি।
উত্তরা দেবী বিভিন্ন জিনিষ তৈরির হাতের কাজও জানেন। বিশেষ করে তিনি বাঁশের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী তৈরিতে বেশ পটু। এক সময়ে সেসব কাজও নিয়মিত করতেন তিনি। তবে পেশাগতভাবে টোটো চালানোকে বেছে নেওয়ায় সেসব কাজ এখন আর করে উঠতে পারেন না। টোটো চালিয়ে কোনও কোনও দিন ১০০ বা ৩০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার হয় তাঁর।
আমোদপুরে টোটো চালকদের মধ্যে পুরুষদের প্রাধান্যই বেশি। এখানে তিনিই একমাত্র মহিলা টোটো চালক। এর পাশাপাশি টোটোর সংখ্যার পূর্বের থেকে বেশ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে এই অঞ্চলে। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাও কম নয় টোটোতে টোটোতে। তবে উত্তরা দেবী কোনও প্রতিযোগিতায় বিশ্বাসী নন। নিজে মহিলা বলে পিছিয়ে যেতেও নারাজ।
তাই অতীতের সমস্ত দুঃখ, মানসিক যন্ত্রণা ভুলে বর্তমানের সমস্ত প্রতিকূলতা, বাঁধা ও বিপত্তিকে কাটিয়ে আমোদপুরের বুকে উত্তরা মহুলির উত্তরায়ণের গল্প দেবী দশভুজার থেকে কোনও অংশেই কম নয়। তার জীবন সংগ্রামের বাস্তব গল্প অনুপ্রেরণা জোগাবে সমাজের প্রতিটি নারীর জীবন সংঘর্ষে।