Advertisement
সোমনাথ মুখোপাধ্যায় : ঐশ্বর্য পরাশর, দশ বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে হঠাৎ ভারত সরকারকে আর টি আই করে জানতে চাইলো, মহাত্মা গাঁধীকে কখন কিভাবে জাতির পিতা বলে ঘোষণা করা হয়েছে? ভারত সরকার তো পড়ল ভারি মুসকিলে, তারা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোন তথ্য দিতে পারল না। শেষ পর্যন্ত তারা বিষয়টি নিয়ে মহাফেজ খানার দ্বারস্থ হলো। কিন্তু সেখান থেকেও গাঁধীজিকে জাতির জনক বলে ঘোষণা করার কোন সুস্পষ্ট তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া গেল না। শেষ পর্যন্ত সরকার জানাতে বাধ্য হলো যে, সরকারি ভাবে (সাংবিধানিক) গাঁধীজিকে কখনও ‘জাতির জনক’ বলে ঘোষণা করা হয়নি। এদিকে ক্লাস সিক্সে পড়া গাঁধী ভক্ত ঐশ্বর্যও ছাড়ার পাত্র নয় সে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দপ্তরে গাঁধীজিকে সরকারিভাবে (সাংবিধানিকভাবে) ‘জাতির জনক’ বলে ঘোষণা করার অনুরোধ জানালো। অগত্যা ভারত সরকার তাকে জানাতে বাধ্য হলো যে সরকার কেবলমাত্র শিক্ষা সংক্রান্ত ও সামরিক উপাধিই প্রদান করে থাকে। এমন কোন উপাধি প্রদান করার এক্তিয়ার বা ইচ্ছা তাদের নেই।
এখন প্রশ্ন হল তাহলে গাঁধীজি জাতির জনক বলে প্রতিপন্ন হলেন কিভাবে! কেই বা তাঁকে কখন জাতির জনক বলে ঘোষণা করলো? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ১৯৪৪ সালের ৬ জুন তারিখে। ভারতের পূর্ব রণাঙ্গনে বর্ষার প্রবল বাধা সত্বেও আই এন এর নেতৃত্বে বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তখন জাঁকিয়ে বসেছে। জাপানি সেনারাও গাঁধী ব্রিগেডের বীরত্ব দেখে রীতিমত অভিভূত। ইতিমধ্যে ৪ জুলাই ১৯৪৪ সালে সবে পালিত হয়েছে নেতাজি সুভাষ এর ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ এর দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম বর্ষপূর্তি। এই সময় ৬ জুলাই নেতাজি সিঙ্গাপুর রেডিও থেকে গাঁধীজি ও ভারত বাসীর উদ্দেশ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘ বেতার ভাষণ দিয়েছিলেন। এই বেতার বার্তায় তাঁর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে ভারত অভিযান পরিকল্পনার বিশদ ব্যাখ্যা ছিল। সেই ভাষণের প্রথমেই তিনি গাঁধীজিকে তাঁর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের মতো সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেন। গাঁধীজি তখন সবে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। অত্যন্ত ভগ্নস্বাস্থ্য। তাছাড়া গত ফেব্রুয়ারি মাসে পত্নী কস্তুরবা গাঁধীর মৃত্যু হয়েছে। এইভাবে বিভিন্ন কারণে তিনি রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত।
নেতাজি তাঁর ৬ জুলাইয়ের ভাষণে দ্বার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন – এমন সর্বশক্তিমান দেশ ব্রিটেন যখন যুদ্ধ জয়ের জন্য ভিক্ষা পাত্র নিয়ে বিদেশী শক্তির দ্বারস্থ হয়েছে সেখানে ভারতের মতো একটি পরাধীন নিরস্ত্র জাতি স্বাধীনতার জন্য যদি বিদেশের কাছে ঋণ বা সহায়তা গ্রহণ করে তাহলে তারমধ্যে অন্যায় কিছু নেই। বিশেষ করে সুভাষ যেখানে জাতির আত্মসম্মান ও মর্যাদা বোধকেই সর্বদা প্রাথমিকতা দিয়ে এসেছেন তাই এতে করে দেশের আত্মমর্যাদার কোন হানি হবে বলেও তিনি মনে করেন না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সময় ব্রিটেনসহ মিত্রশক্তির দেশগুলি জার্মানি ও জাপানের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে আমেরিকার কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থী হয়েছিল। এবং সেই জন্য আমেরিকা প্রথমে ক্যাস অ্যান্ড ক্যারি পরে ল্যেণ্ড অ্যান্ড লিজ নীতি গ্রহণ করেছিল।
নেতাজি আরও বললেন তিনি যা করছেন তা কেবলমাত্র ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য পূরণের জন্যই করছেন। ভারত স্বাধীন হলেই যে আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হয়েছে তার কাজ শেষ হবে। পরবর্তী সময়ে ভারতের জনসাধারণ তাদের পছন্দমত সরকার গঠন করবেন। তিনি ও তাঁর সহযোগীরা ভারতের জনসাধারণের দাস মাত্র। মাতৃভূমির মুক্তি ছাড়া অন্য আর কিছুই তাঁরা চান না। দেশ স্বাধীন হয়ে গেলে তাদের অধিকাংশই রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে অবসর নেবেন, বাকিরা যেকোনও ছোট কাজ পেলেই খুশি থাকবেন। তিনি সেদিন যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ হল ব্রিটিশ শাসনের অধীনে কোন উচ্চ পদে কাজ করা অপেক্ষা স্বাধীন ভারতের মেথর হওয়াও অনেক মর্যাদাজনক।
তিনি তার ভাষণের একদম শেষ পর্যায়ে এসে অত্যন্ত বিনীত ও আবেগ জড়িত কন্ঠে বললেন, “জাতির পিতা ভারতের মুক্তির এই পবিত্র যুদ্ধে আমরা আপনার আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা প্রার্থনা করি”। এস এ আইয়ার এই ভাষণ রেকর্ডিং এর একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি লিখেছেন, ভাষণের শেষ ছত্রগুলি উচ্চারণের সময় তাঁর কন্ঠ কেঁপে যায় এবং মুখে এক গভীর ভাবাবেগের ছাপ ফুটে ওঠে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে জাতির পিতা হিসাবে গাঁধীজিকে আখ্যায়িত করেছিলেন ভারতের প্রথম অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকারের সর্বাধিনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। পরবর্তীকালে সরোজিনী নাইডু দ্বিতীয়বার একটি সভায় গাঁধীজীকে জাতির পিতা হিসাবে উল্লেখ করেন। এইভাবে মহাত্মা গাঁধী জাতির পিতা হিসেবে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ভারতের জনসাধারণের কাছে মান্যতা পান। স্বাধীন ভারতের সরকার গাঁধীজিকে জাতির পিতা হিসাবে ঘোষণা না করলেও দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রের দেওয়া উপাধি ‘মহাত্মাজি’ আজও সগৌরবে বহন করে চলেছেন।
Advertisement